হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় লাখো তরুণ। কেউ বেকার, হন্যে হয়ে খোঁজে চাকুরি। কেউ কেউ শুধু বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করা জন্য কিংবা পাছে লোকে কিছু বলবে, অথবা পরিবারের চাপে দিনের পর দিন নিরানন্দ মনে টেনে যায় চাকুরির ঘানি। স্বপ্নহীনতার এক ঘোরে আটকা পড়েছে তারা, এক অনিশ্চিত শূন্যতায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে অদম্য শক্তি নতুন প্রাণ; একটি বীজ থেকে অতি সামান্য এক কুঁড়ি মাটির কঠিন বুক ভেদ করে ঘোষণা করে নিজের অস্তিত্ব। এ যদি হয় ঊষা, তবে তারুণ্য হলো মধ্য গগণের অমিত তেজী সূর্য। তরুণদের শ্রমে, ঘামে ও রক্তে বাংলা নামের দেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।
কিন্তু আমাদের তারুন্য!! লড়াকু মনোভাবের অভাব; হেরে যাবে জেনেও না হারার মানসিকতার অভাব নিয়ে নিদারুণ এক দীর্ঘ যাত্রায় চলা আজব এক প্রজাতি। আর এই লড়াকু মনোভাব না থাকার পেছনে রয়েছে রোল মডেল বা আইকনের অভাব। সত্যি কি কোনো আইকন নেই? কে বলেছে নেই; অবশ্যই আছে। ভুরি ভুরি না হলেও আছেন অনেক আইকন, এবং তাদের সবাই এলন মাস্ক কিংবা মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো বিদেশি নয়। শতভাগ বাংলাদেশি। বিশ্ব গণমাধ্যমকে যারা প্রতিনিয়ত লিখতে বাধ্য করছেন স্বদেশের নাম। রঙ-তামাশার অতি উৎসাহে আর তথাকথিত সমাজের চোখে যাদের অর্জনগুলোকে আমরা দেখেও দেখি না, কিন্তু ভুগতে থাকি একরাশ হতাশার নিরন্তর দুষ্টচক্রে।
মাত্র কয়েকদিন আগেই দেশের সব গণমাধ্যম এসেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাহমুদা সুলতানার নাম। মহাশূন্যে ব্যবহারের জন্য যুগান্তকারী ক্ষুদ্র ডিভাইস উদ্ভাবন করে তিনি জিতে নিয়েছেন নাসা’র গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ‘আইআরএডি ইনোভেটর অব দ্যা ইয়ার-২০১৭’ পুরস্কার । প্রযুক্তির উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর এ পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে।
কৈশোরে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়, এরপর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমআইটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন মাহমুদা।
তালিকার এমনই আরেক ব্যক্তি, সাদ আহমেদ। তিনি একদল বিজ্ঞানীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভ্রুণ অবস্থা থেকে হৃদপিণ্ড গঠন প্রকৃতি, এবং এর মাধ্যমে বংশগত হৃদরোগের কারণ খুঁজে বের করা। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সাদ আহমেদকে এ গবেষণা কাজ চালিয়ে নিতে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন দিয়েছে দুই লাখ ৩২ হাজার ডলারের অনুদান ।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা বিজ্ঞানী সাদ একা নন। কারণ ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসা উদ্ভাবনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশি গবেষক ড. দেবানন্দ সরকার। তিনি এবং তার দল যকৃত ক্যান্সারে ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি প্রতিরোধী একটি জিন আবিস্কার করেছেন। এছাড়া তারা আরও একটি জিন আবিস্কার করেছেন, যা যকৃত ক্যান্সার বিস্তারে ভূমিকা রাখে। ড. সরকার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র, জাপান থেকে পিএইচডি, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টোরাল ডিগ্রি শেষ করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
এতটুকু পড়ার পর অনেকে বলতে পারেন, বিদেশ বসে এ সব করা সম্ভব। কিংবা এরা তো কেউ নিজ দেশে চোখের সামনে নেই, তাই আইকন হয়ে ওঠে না। তাদের জন্যও আছেন কয়েকজন যারা বাংলাদেশেই বসবাস করেন এবং তাদের কাজ লাভ করেছে উচ্চ সারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
প্রথমে বলা যাক ডা: সায়েবা আক্তারের কথা। বাংলাদেশের এ প্রথিতযশা চিকিৎসক সহজলভ্য ও সস্তা উপকরণ দিয়ে এমন একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন, যা সন্তান জম্নদানকালীন সময়ে প্রসূতি মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। তার এ পদ্ধতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন ইন্টারন্যাশানাল মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ‘সায়েবা’স মেথড’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পাওয়া এ পদ্ধতি ইন্দোনেশিয়া, নেপাল , পাকিস্তান, ভারত, পূর্ব তিমুরে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এবার আসা যাক আরেক বাংলাদেশি চিকিৎসকের কথায়, যিনি চলতি ২০১৭ সালের ‘কার্লোস জে ফিনলে ইউনেস্কো প্রাইজ ফর মাইক্রোবায়োলজি’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ঢাকা শিশু হাতপাতালে অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ড. সমীর সাহা পাকিস্তানের অধ্যাপক শাহিদা হাসনানের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে এ পুরস্কারে ভূষিত হন। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সাহা মেনিনজাইসের টিকা প্রদান কর্মসূচি বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
নিমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসে পুঁজ জমে ফুলে ওঠে, এতে কমে যায় অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা। উন্নত বিশ্বে এ ধরনে রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যার এক একটির দাম বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ লাখ টাকা। দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারা অঞ্চলে প্রতিবছর ৯ লাখের বেশি শিশু নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
শিশুদের এ করুণ পরিণতি ভীষণভাবে নাড়া দেয় বাংলাদেশি চিকিৎসক ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতিকে। দুই দশক গবেষণার পর তিনি শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে এক ধরনের ডিভাইস তৈরি করেন, যা একই সাথে সস্তা ও কার্যকরী। তার এই ডিভাইসের দাম ১৫০ টাকারও কম। ড. চিশতির এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে।
দেশে কিংবা বিদেশে এমন অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা সত্যিকারের আইকন। সবার নাম হয়তো আমরা জানি না; আর জানি যে কজনের নাম তাদের সবার কথা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। তারা থাকেন রোজকার সস্তা জনপ্রিয়তা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথাকথিত ‘সেলিব্রেটি’ তকমার বাইরে। নিজ নিজ ভুবনে থাকলেও তারা কিন্তু কাজ করে চলেছেন আপামর জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য, তথা মানব সভ্যতার জন্য। নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল করেছেন বাংলাদেশের নাম। অথৈই হতাশার মাঝে এরাই বাংলাদেশের তারুণ্যের সত্যিকারের আইকন; শুধু বোধের জায়গাটা স্বচ্ছ হওয়া চাই।