মস্কো থেকে টোকিও, ব্রিসবেন থেকে মন্ট্রিয়ল সারা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের জীবনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না, ইদানিং টুকটাক সমালোচনাও হয়। সিনেমার রিভিউ লেখার সময় আপনি যে পক্ষেই থাকুন না কেন, ব্র্যান্ডিংয়ের দুনিয়ায় শাহরুখ খান যে চৌকসতম জাদুকরদের একজন সেটা অস্বীকারের সুযোগ আপনার নেই।
বোম্বের থুক্কু মুম্বাইয়ের বলিউড পাড়ায় তো ‘স্টার’-এর অভাব নেই, এমনকি সুপারস্টারও আছে কাঁড়ি কাঁড়ি। একাই বয়ে নিয়ে যেতে পারেন আস্ত সিনেমাকে। বাজারে আছেন আমির খান, সালমান খানের মতো সব সুপারস্টারেরা, আছেন অক্ষয়কুমার আর অজয় দেবগনের মতো পাক্কা খিলাড়িরাও। তবে এত ঘটা করে শাহরুখ খানের নাম কেন বলা হয়? প্রশ্নটা পুরোপুরি সঠিক হলো না। প্রশ্ন হতে পারত বলার কি নেই?
সিনেমার হলের অন্ধকারের মাঝে আলো ঝলমলে পর্দায় শাহরুখের রোমান্টিক ও থ্রিলিং উপস্থিতিতে বেশির ভাগ দর্শক এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন যে পর্দায় বাইরে এসআরকের অভিনব সব কাজ ও সাফল্য রয়ে যায় দৃষ্টির বাইরে। শাহরুখ খানকে শুধু একজন অভিনেতা বা সুপারস্টার হিসেবে নয়, বিবেচনা করা উচিত অসাধারণ এক ব্র্যান্ড জাদুকর হিসেবে। তিনিই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র নায়ক যিনি নিজেই নিজেকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাহরুখের নিজের প্রযোজিত রা.ওয়ান মুক্তির আগে সমালোচকদের কৃপা পায়নি। অনেকেই সিনেমাটির ব্যবসা সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বিলকুল খারিজ করে দেন। কিন্তু শাহরুখ খান নিজের ব্র্যান্ড ইমেজ ব্যবহার করে সনির প্লে-স্টেশন, ম্যাকডোনাল্ড’স, ভিডিওকন, নকিয়া, কোক, সিনথল, ইন্ডিয়ান গ্রাঁ প্রি, আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ, ইএসপিএন স্টারের মতো কর্পোরেটদের সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন; ফলে এনডোর্সমেন্টের ধাক্কায় মুক্তির পর দেখা গেল সিনেমাটির আয় ১৫০ কোটি রুপি ছাড়িয়েছে।
২০০২ সালে, শাহরুখ ও তার স্ত্রী গৌরি যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্ট। সেসময় থেকেই তার অভিনীত অধিকাংশ সিনেমাই নিজের টাকাতে তৈরি। নিজের চেহারা বা নামের বদৌলতে ব্যবসায়িক আয়ের পুরোটাই যায় তার পকেটে। ঠিক ঝানু ব্যবসায়ীর মতো চিন্তা।
শুধু সিনেমা কিংবা নিজের ব্যবসা নয়, তার ওই চেহারার বাজার মূল্য যে কোনো নামী-দামি ব্র্যান্ডকেও হার মানাবে। তাকে মডেল, আইকন হিসেবে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে দুনিয়ার বড় বড় পণ্য ও সেবার জোগানদার প্রতিষ্ঠানেরা। কেনইবা হবে না, বিজ্ঞাপনে শাহরুখ খানের উপস্থিতি মানেই বাজিমাত। পান মাসালা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল গাড়ি, হেন কোনো পণ্য নেই যার বিজ্ঞাপণ তিনি করেননি। শুধু পান মাসালা’র বিজ্ঞাপন বাবদই তিনি নিয়েছিলেন ২০ কোটি রুপি। বিজ্ঞপণের ফলে পণ্যের প্রসারের সম্ভাবনা না থাকলে কেউ কি শুধু মুখ দেখে অতগুলো টাকা দেয়?
ক্রিকেট বা অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সেলিব্রেটিরা যুক্ত থাকলেও উদ্যোক্তা হিসেবে শাহরুখ অন্যদের থেকে একদমই আলাদা, এমনকি জাত ব্যবসায়ীদের থেকেও তিনি যেন এক কাঠি সরেস! আইপিএলের গল্প তো আমরা সবাই জানি কিন্তু ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগের ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো দলের মালিকও তিনি। শুধু বিনোদনের ব্যবসা নয়, তার পদচারণার পরিধি বিভিন্ন পরিমণ্ডলেই দিন দিন আরও বাড়ছে। ভারতজুড়ে বাংলাকে ‘সুইটেস্ট ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ হিসেবে তুলে ধরতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গেও কাজ করছেন। আর সবার মতো কেবল মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে টেড টকে বক্তব্য দিয়েই কাজ সারছেন না, আস্ত টেড টক নিয়ে আসছেন ফ্রাঞ্চাইজি করে ভারতে। এর বাইরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়েও আমন্ত্রিত হয়ে দিয়েছেন বক্তব্য।
তাই শাহরুখকে কেবল একজন অভিনেতা বলে আর বিবেচনা করার সুযোগ নেই। একজন চমৎকার বিপণনকারী হিসেবে বাজার বিশ্লেষকদের হাতে ব্যবচ্ছেদ হওয়া উচিত তার বিজনেস মডেল। ৫২ বছর বয়সী শরণার্থীর ছেলে শাহরুখ একজন অসাধারণ ব্র্যান্ড জাদুকর, যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। সম্ভবত সেকারণেই অভিনেত্রী নেহা ধুপিয়া একবার বলেছিলেন, ‘ওনলি সেক্স অ্যান্ড শাহরুখ সেলস ইন ইন্ডিয়া’। বলিউডের সেরা সেলসম্যানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।