খাঁচা, মুক্তি পেয়েছিল ২২ সপ্টেম্বের। ঢাকার বাইরের হলগুলোতে যেমনই চলুক, ঢাকার বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে সিনেমাটি একদম মন্দ চলছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলোচনার গুরুত্ব নিদেনপক্ষে তাই বলে। গুরুত্ব দেখে প্রভাবিতও হলাম, আগ্রহ হলো সিনেমাটি দেখার। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মুক্তির দিন টিকিট না পেয়ে অনেকেই না কি ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম একটু আয়েশ করে রয়েসয়ে সিনেমাটা দেখতে যাবো। পরিকল্পনায় ছিল দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্র-শনিবার। কিন্তু হায়! পরের সপ্তাহেই সিনেমাটা মুক্তি দিয়েও দেওয়া হলো বোকাবাক্সের পর্দায়। সেজন্য নামিয়েও নেওয়া হলো হল থেকে, এক সপ্তাহের মাথাতেই। শুক্রবার সিনেপ্লেক্সের কাউন্টারে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, আর কাউন্টারের লোকগুলোও আমার দিকে অবাক তাকিয়ে রইল!
সরকারি অনুদানে আকরাম খান পরচালিত খাঁচা চলচ্চিত্রটি একযোগে সারা দেশে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হলেও গুনে গুনে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের একটি করে মোট ছয়টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। কেবল খাঁচা-র ক্ষেত্রেই নয়, এমনটি ঘটে চলেছে আরো অনকে সিনেমার ক্ষেত্রেই। সেরা কাহিনি বিবেচনায় গত বছরের চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ততম তালিকা করলেও তাতে স্থান করে নেবে অজ্ঞাতনামা। এরপরও সিনেমাটিতে খাঁচা’র মতোই একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। অনেকটা নিভৃতেই ১৯ আগস্ট হলে মুক্তি পায় সিনেমাটি। তারপর হল থেকে নেমেও যায় কোনো আলোড়ন না তুলেই। সিনেমাটিকে নিয়ে প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো প্রচারণাই চালানো হয়নি। অথচ অনলাইনে ছাড়া হলে কোনো প্রচারণা ছাড়াই কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দর্শকেদর মধ্যে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করে সিনেমাটি।
আমাদের দেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ অনুদান বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা দিয়ে যে সিনেমা বানানো যায় না। ফলে সরকারি অনুদান লাভের পরও পরিচালকদের দৌড়ঝাপে নামতে হয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে রাজি করাতে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এ বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোও জানে! এফডিসি ঘরানার বাইরে তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর জন্য এ যেন নৈমিত্তিক দৃশ্যপট। সিনেমাগুলো নামকাওয়াস্তে কয়েকটা সিনেমা হল কিংবা সিনেপ্লেক্সে পাবে, এক-দুই সপ্তাহ চলবে, তারপর মুক্তি দেওয়া হবে কোনো একটা টেলিভিশনে। সেটার আবার একটা গালভরা তকমা দেওয়া হয়ে থাকে- ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। যেন এটাই এ ধরনের সিনেমা তৈরির মোক্ষম উদ্দেশ্য। হলে সিনেমা মুক্তি দেওয়াটা নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা, প্রয়োজনটা মূলত টিভি-কেন্দ্রিক! একদিকে মূলধারার বাইরের চলচ্চিত্রগুলোর বিরুদ্ধে এফডিসি কেন্দ্রিক প্রযোজক-প্রদর্শকদের জোটবদ্ধ প্রতিরোধ-প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এফডিসি’র বাইরের প্রযোজকদের মধ্যে কাজ করে সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শনে অনীহা। সিনেমাগুলোর হলে প্রদর্শনের এ নেতিবাচক মনোভাব দুই পক্ষের মধ্যেই কমবেশি এক, ফলাফলেও তাই ঘটে না ব্যতিক্রম ।
দুনিয়া জুড়ে প্রযোজকদের মোক্ষম উদ্দেশ্য সিনেমায় অর্থলগ্নি লাভের মুখ দেখা। আমাদের দেশের প্রযোজকরাও এর ব্যতিক্রম নন, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের চলচ্চিত্রের বাজারের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক লক্ষ্যটাও কম দুরূহ নয়- লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া। হল দখলের মারপ্যাঁচে পড়ে লগ্নিকৃত অর্থ তুলে আনতে মূলধারার বাইরের প্রযোজকরা দিন দিন হলের বাইরের উৎসের প্রতিই বেশিই আকৃষ্ট হচ্ছেন। হলের বাইরের উৎসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে টিভি প্রিমিয়ার। হলে সিনেমাটি দেখিয়ে টাকা তোলার তুলনায় কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রিমিয়ার করে দিলেই দ্রুত টাকা তোলা সম্ভব। সিনেমার দৈর্ঘ্য বড়, প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা। কাজেই বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ অনেক বেশি। এখন যদি সিনেমার বাজেট একটু কম রাখা যায়, তবে টিভি প্রিমিয়ারসহ অন্যান্য আয়-রোজগার নিশ্চিত করা গেলেই কেল্লা ফতে। তখন হলের আয়-রোজগারের থোড়াই পরোয়া করার দরকার পড়ে।
তবু মূলধারার বাইরের যে সব সিনেমা এক কিংবা দুই সপ্তাহের জন্য হলেও হলে চলে, সেগুলো ভাগ্যবানই বলা যেতে পারে। বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য আইন-কানুনের মারপ্যাঁচ ও অন্যান্য বিবিধ কারণে এই চলচ্চিত্রগুলোর তো তাও রূপালি পর্দায় মুক্তি পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটেছে। এই ঘরানার অনেক চলচ্চিত্র তো রূপালি পর্দার মুখই দেখে না। সরাসরি মুক্তি পায় বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের অর্থকরী পর্দায়। এই যেমন ২০১৬-এর রোযার ঈদে টিভি পর্দায় মুক্তি পায় দর্পণ বিসর্জন।
মাঝের একটা সময়ে অবশ্য এই প্রবণতার নিয়ে তেমন ভাবনার সুযোগ ছিল না। তখন দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থাই ছিল ভীষণ রুগ্ন। মানসম্মত দূরে থাক, ন্যূনতম রুচিশীল সিনেমা তৈরি হচ্ছিল না। হলগুলোর পরিবেশও ছিল ভয়াবহ। এমনকি হল সংখ্যাও কমছিল বেশ দ্রুত। অশ্লীলতায় ভরে উঠেছিল প্রায় পুরো চলচ্চিত্র শিল্প। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প দিনেক দিন অন্ধকারের পথে যাত্রা করছিল। এসব নিয়ে তখন গণমাধ্যমগুলোও বেশ সোচ্চার হয়েছিল। এমনই সংকটময় সময়ে চলচ্চিত্র শিল্পের এই প্রবণতার শুরু- টিভি পর্দায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন। যাত্রা শুরু করে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। তাতে লাঠি না ভেঙেই সাপ মারা যায়- অচলাবস্থা বিরাজ করা চলচ্চিত্র শিল্পকে ঢেলে না সাজিয়েই কম বাজেটে অশ্লীলতা মুক্ত রুচিশীল চলচ্চিত্র দেখানো যায়। আপৎকালীন কর্মপন্থা হিসেবে ব্যাপারটা বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল, হলগুলোর পরিবেশ একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল, তখনো মূলধারার বাইরের অধিকাংশ প্রযোজকরা তাদের কর্মপন্থা থেকেও সরে আসেনি। তাই একেবারেই হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, পুরানো ছকে মূলধারার বাইরের প্রায় সব সিনেমাই এখনো এক রকম হল বিচ্ছিন্ন।
অথচ ভিন্ন ধারার এই চলচ্চিত্রগুলোর হল দখলের লড়াইয়ে নামার সময় এসে গেছে, চাইলে এই চলচ্চিত্রগুলোও যে হলে দাপট দেখাতে পারে, তার প্রথম প্রমাণ ছিল মনপুরা (২০০৯)। সাম্প্রতিক স্বাক্ষ্য আয়নাবাজি (২০১৬), মাঝে অনেক চলচ্চিত্রই সে ইঙ্গিত বহন করেছে। লড়াইটা এখনো হয়তো বেশ কঠিন; আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের সামগ্রিক কাঠামোটা সেকেলে এবং ঘাটতি রয়ে গেছে মেধা ও যুগোপযুগী পেশাদারিত্বে। এরপরও মূলধারার বাইরের চলচ্চিত্রগুলোকে অন্তত হল দখলের লড়াই করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। খাঁচা (২০১৭), অজ্ঞাতনামা (২০১৬), ঘাসফুল (২০১৫), গাড়িওয়ালা (২০১৪), মৃত্তিকা মায়া (২০১৩), শিখণ্ডী কথা (২০১৩), রানী কুঠির বাকি ইতিহাস (২০০৬), বিদ্রোহী পদ্মা (২০০৬) এর মতো চলচ্চিত্রগুলোকে মূলধারার চলচ্চিত্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামানো বিশেষভাবেই প্রয়োজন।
প্রয়োজনটা আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের খাতিরেই জরুরি। মূলধারার বাইরের এই চলচ্চিত্রগুলো ভালো হোক কি মন্দ হোক, এগুলোরও দর্শক প্রয়োজন। সেই দর্শক শ্রেণি কতটা তৈরি হলো, তারা হলে আসতে কতটা আগ্রহী, সিনেমাগুলো হলে সুযোগ না পেলে এইসব জরুরি বিষয়ে বোঝাপড়া কিভাবে সম্ভব হবে? সেজন্য এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রচারণা ও হলে প্রদর্শন দুটোই ভীষণ জরুরি। তখনই বোঝা যাবে। আমাদের চলচ্চিত্র এবং আমাদের দর্শক- দুই পক্ষের মধ্যে কে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছ। তা না হলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের সংকটও দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মতো চিরস্থায়ী হয়ে যাবে- ভালো সিনেমা নেই বলে ভালো দর্শক নেই, ভালো দর্শক নেই বলে ভালো সিনেমা নেই।
প্রযোজকদের এ বিষয়ে বোধোদয়ের হোক; এই কামনা করা ছাড়া আমাদের আর কীই-বা করার আছে, হলের কাউন্টারে গিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া!