ডিমান্ডিং ডিম দিবসের শুভেচ্ছা!

কী মুশকিল! রক্তিম শুভেচ্ছা, সংগ্রামী শুভেচ্ছা, লাল গোলাপ শুভেচ্ছা, দিবসভেদে কতো রকমফেরই না আছে শুভেচ্ছার। কিন্তু ডিম দিবসের সঙ্গে কোন বিশেষণটা উপযুক্ত হবে তার ব্যাপারে কোনোভাবেই মনস্থির করতে পারছি না। আর মন স্থির না হলে কি আর এই বিশেষ দিবসের বিশেষ লেখা শুরু করা যায়?

যাই হোক। সবাইকে বিশ্ব ডিম দিবসের ‘পুষ্টিকর’ শুভেচ্ছা। ডিম দিবস বলতে যে কিছু আছে তা-ই আমার ওয়াইল্ডেস্ট ইমাজিনেশনে আসা সম্ভব ছিলো না। সোশ্যাল মিডিয়ার উপদ্রব না থাকলে হয়তো ওসব ভাবার প্রয়োজনও হতো না। আমাদের অফিসে সপ্তাহের একটা দিন ডিম ভুনা দেওয়া হয়। ওই দিনটি অলিখিতভাবে এমনেই ‘ডিম-বার’ নামে পরিচিত। আমার আলাদা করে অন্য কারো ডিম দিবসের কী দরকার বলুন? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো, বেশ অনেক বছর আগে শুক্রবারে মসজিদের গেটে একবার একটা সরকারি লিফলেট পেয়েছিলাম। টগবগে কিশোর বয়স তখন। পড়ার মতো যা-ই পাই, তাই-ই পড়ি। তো লিফলেটটায় ছিলো ডিম খাওয়ার উপকারিতার ফিরিস্তি। সম্ভবত কোনো ডিম দিবসের প্রেক্ষাপটেই দেওয়া (সম্ভাবনা প্রবল, ওটাও শুক্রবার ছিলো। অক্টোবরের দ্বিতীয় শুক্রবার নাকি ডিম দিবস)। না হলে ৩-৪টা ফ্ল্যাপ জুড়ে ডিমের গুণাগুণ কেন দেবে। লিফলেটের আর সব তথ্য বেমালুম ভুলে গেলেও দুটো বিষয় এই এত বছর পরও ঠিক ঠিক মনে আছে। প্রথমটা হলো, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নাকি বছরে গড়ে ৩৬৫টা (!) ডিম গেলা দরকার। দ্বিতীয়টা ডিম খাওয়ার মাহাত্ম্ তুলে ধরতে একটি এক্সক্লুসিভ ইনফো। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ব্রেকফাস্টে ডিম নাকি চাই-ই চাই। তা এই প্রতিদিন ডিম খাওয়ার গরমে পরবর্তীতে কী হয়েছিলো সে আলাপে আপাতত না গেলেও চলে। আসল বিষয় হলো লিফলেটের তথ্য আমাকে অন্তত কনভিন্স করতে পারেনি। পাগল নাকি? বছরে অন্তত ২০-২২ দিন তো হাফ-ইয়ারলি আর অ্যানুয়াল পরীক্ষা, আর তারপর গাদা গাদা ক্লাস টেস্ট, স্যারের বাসায় পরীক্ষার দিনগুলোয় ডিম খেয়ে পরীক্ষার খাতায় ‘আণ্ডা’ জোটাই আর কী!

ওহ, আণ্ডার কথায় আরো একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ছোটোবেলায় এনইসিসির ডিম খাওয়ানো বিষয়ক বেশ মজার একটা ভারতীয় ক্যাম্পেইন ছিলো- “সানডে হো’ ইয়া মানডে, রোজ খাও আন্ডে”! ভারতীয়দের ডিম খাওয়ানোর জন্য এত তোড়জোড় চালিয়েছিল এনইসিসি, যে বলার নয়। শচিন টেন্ডুলকার, অমিতাভ বচ্চন, দারা সিং, কাকে দিয়ে না বলিয়েছে সানডে-মানডে বাছবিচার না করে হররোজ ডিম খাওয়ার কথা। আমাদের এখানেও বিপিআইসিসি-র ঘোষণায় তেমন ইচ্ছেটাই ছিলো, তবে ওটার সানডে-মানডে ক্লোজ আধঘণ্টার মধ্যেই। যে কতিপয় লোকের ভাগ্যে ডিম জুটেছিলো, সেগুলোও ‘ডিমড়ে-মুচড়ে’ একাকার। ডিম নিয়ে কেনো ঘটলো এই অরাজকতা? হুট করে কেনোই বা বেড়ে গেলো ডিমের ডিমান্ড। বিষয়টার যৌক্তিকতা একেবারেই মেলাতে না পেরে শেষমেশ সরেজমিনে ঘুরে না এসে কাল্পনিক কার্যকারণগুলো একে একে নিচে দেয়া হলো:

১. দোষ আসলে কুদ্দুস বয়াতী সাহেবের। ডিম নিতে এসে যখন অনেকে ডিম না পাওয়ার বেদনায় কাতর, বেশিরভাগই নিয়তি মেনে নিয়ে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আকাশে-বাতাসে তখনও শুরু হয়নি ডিম হারানোর হাহাকার। ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেনো বেজে উঠলো পরিচিত সুর, “এই ডিম ডিম না, আরো ডিম আছে। এই ডিমেরও নিবা তোমরা সেই ডিমেরও কাছে- এ-এ-এ-এ-এ-এ-এ”। এরপর বাকিটা ডিম ভাঙার করুণ ইতিহাস।

২. তিন টাকায় একটি করে ডিম কিনে বাড়ি যাবার আসায় অনেকেই দু’টো করে দুই টাকার কয়েন নিয়ে এসেছিলেন। আশা ছিলো একটি ডিমের সাথে একটি করে ম্যাংগো ক্যান্ডি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। যেই না খবর ছড়ালো ম্যাংগো ক্যান্ডি তো নেই-ই, আবার একটা করে ডিম কেনা যাবে না, মাথায় বজ্রসহ ডিম পড়লো যেনো। মুহূর্তেই দাবানলের মতো কৃষিবিদের এমাথা থেকে ওমাথা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে জনতা।

৩. যে হারে সেলিব্রেটিরা সবাই গায়কের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, তাতে অচিরেই তাদের ওপেন এয়ার কনসার্ট হবার সম্ভাবনা প্রবল। সে সময় যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত থাকে সে উদ্দেশ্যেই অনেকে ভিড় করেন ডিম সংগ্রহের জন্য। কিন্তু হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ! কেউ পেলো আর কেউ পেলো না। বৈষম্যের চিন্তা পরে, আসন্ন কনসার্টগুলোয় সাথে ডিম থাকবে না এই আশঙ্কায় হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায় জনগণের।

৪. বিশ্বস্ত না এমন সূত্রে জানা যায় পুরোটাই নিখিল বাংলাদেশ গ্রিল অ্যান্ড ফ্রায়েড চিকেন কনজুমার্স (বিজিএফসিসি) সমিতির নীলনকশা। এভাবে সস্তায় ডিম পেলে পরে ডিম খাওয়ায় অভ্যস্ততা তৈরি হবে আর তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে এই ভয়েই ভজঘট পাকানোর এই ষড়যন্ত্র।

৫. যথারীতি আরো একটা গানের ভুল ইন্টারপ্রিটেশন। বাপ-চাচার মুখে দীর্ঘশ্বাসের সুরে শোনা “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” অনেকে “কি সুন্দর ডিম ফাটাইতাম” হিসেবে ইন্টারপ্রেট করে। এ নিছক ভুল বোঝাবুঝি। ওদের দোষ দেওয়ার আগে সিস্টেম ঠিক করুন ইয়োর অনার।

৬. বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, সংক্ষেপে বিপিআইসিসি-র উদ্যোগে ছিলো এ স্বল্পমূল্যে ডিম বিতরণ কার্যক্রম। এখন কতিপয় জনগণ বিপিআইসিসি পড়তে গিয়ে শুধু ‘আইসিসি’ পড়েছে, আর কে না জানে আইসিসি মানেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। দেশের শত্রু। শত্রুর কোনো কৌশল ভণ্ডুল করে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব।

৭. দেখুন সফলতা কীভাবে আসলো সেটা বড় কথা না। আসল বিষয় সফল হওয়া। বিপিআইসিসি জানিয়েছে এ কার্যক্রম ব্যর্থ নয়, সফল। তার মানে যা হয়েছে তা ভুলে পার্টি করতে পারেন। তবে সাবধান, পার্টি ফিস্টে ডিমের আইটেম রাখবেন না।

৮. কী নির্মম! পারবেন এরপর মুরগিদের সামনে মুখ দেখাতে??

৯. সত্যিই তো! এ কেমন বিচার??

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনেকের ডিম হারানোর বেদনায় আমিও কাতর। তারপরও এ স্যাটায়ারের মর্মার্থ না বুঝলে লেখক দায়ী নন।