“হ্যান্ডস আপ। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।” সুপরিচিত এই তিনটি লাইন আপনি যখন শুনছেন ততক্ষণে আপনি হয়ত সিনেমা হলের এক্সিট ডোর পার হচ্ছেন কিংবা চ্যানেল পালটে অনুষ্ঠানান্তরে পাড়ি জমাচ্ছেন। কারণ সিনেমা শেষ। নায়কের কাজ নায়ক করে দিয়েছে। ভিলেন মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। যখন আর ঘটতে কিছুই বাকি নেই, অপরাধীদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে একদম শেষ দৃশ্যে পুলিশ হাজির। অথচ বাস্তব চিত্র একদম উল্টো। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানিদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’র বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলার স্বাধীনতাকামী পুলিশ বাহিনী। আবার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলায় হোলি আর্টিজানে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। মূলত সর্ব সংকট মোকাবেলায় আমাদের প্রথম অবলম্বন পুলিশ। কিন্তু দুর্নীতি আর অদক্ষতার গল্পে চাপা পড়ে যায় তাদের অসংখ্য বিজয়ের গল্প। তেমনই একটি ট্রেডমার্ক বিজয়ের গল্প নিয়ে পর্দায় হাজির- ঢাকা অ্যাটাক।
টিভি নাটকের পরিচিত নাম দীপংকর দীপন ঢাকা অ্যাটাক সিনেমার পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হলেন সিনেমার জগতে। একই সঙ্গে চিত্রনাট্য লেখিয়ে হিসেবে নাম লেখালেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সানী সানোয়ার। এই দুজন এবং তাদের টিম দর্শকদের উপহার দিল অভিনব এবং অথেনটিক পুলিশিংয়ের গল্প। মূল চরিত্র- আবিদ রহমানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আরেফিন শুভ এবং তার সঙ্গে জুটি বাঁধতে চৈতি চরিত্রে লাস্যময়ী সাংবাদিকের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে লড়েছেন মাহিয়া মাহি। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন এবিএম সুমন, শতাব্দী ওয়াদুদ, আফজাল হোসেন, আলমগীর, সৈয়দ হাসান ইমাম, কাজী নওশাবা আহমেদ এবং যার কথা না বললেই নয়- খল চরিত্রে সিনেমার অন্যতম চমক- তাসকিন রহমান।
ঢাকা শহরে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে একের পর এক বোমা হামলা করে চলছে সন্ত্রাসীরা। যাদের নির্মূলে ডাক পড়ে পুলিশ অফিসার আবিদের এবং তার সঙ্গে যোগ দেয় সোয়াট কমান্ডার আশফাক হোসেন (এবিএম সুমন)। এবং সবগুলো অপারেশন নেতৃত্ব দেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাজেদুল করিম (শতাব্দী ওয়াদুদ)। একের পর এক বোমা হামলা আরও নতুন নতুন ‘ক্লু’ নিয়ে সামনে হাজির হয়। অপরাধের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের সন্ধানে চলতে থাকে পুলিশি অপারেশন। এবং সব শেষে অবধারিতভাবে ধরা পড়ে সন্ত্রাসী। সংক্ষেপে এই হলো গল্পের প্লট। কিন্তু আপাত সাদামাটা এই গল্পের ভেতরে আছে সমসাময়িক ঘটনাবলি এবং গোটা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে রাখা এক সংকটের ইশারা।
একটা একক বোমা হামলার ক্লু উদ্ধার করতে গিয়ে হদিস মেলে আরেকটি ক্লুর। হামলাকারীর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য অপরাধচক্র এবং তাদের নেটওয়ার্ক যে অনেক বিস্তৃত তার সফল অনুসন্ধান চোখে পড়ে ঢাকা অ্যাটাকের গল্পে। গল্পের অগ্রগতি রৈখিক হলেও তা পরিপক্ব হয়েছে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য ঘটনাবলিকে সমান্তরালভাবে সঙ্গে নিয়ে। তাই মেদহীন এই গল্পে প্রয়োজনীয় ‘ডিটেল’এর ঘাটতি ঘটেনি। বরং কমপ্লিমেন্ট করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। আর এতে শুধু বিশ্বাসযোগ্যই হয়ে ওঠেনি, সিনেমায় যে বাস্তবতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে তাও সার্থক হয়েছে। আবার গল্পে চিত্রায়ণের জন্য যে কারিগরি সংযুক্তির প্রয়োজন ছিলো তাও খুঁজে পাওয়া গেছে। সেজন্যেই পুলিশের এবং সোয়াট টিমের অপারেশন সার্থকভাবেই হাজির হয়েছে পর্দায়। বাংলা সিনেমায় যখন গল্প খরা চলছে তখন এরকম দুর্দান্ত গল্প উপহার দেওয়ার জন্য প্রশংসা পাবেন সানী সানোয়ার।
নির্মাতারাই একে বলছেন বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ অ্যাকশন-থ্রিলার। আদতে এরকম ‘পুলিশ অ্যাকশন এবং থ্রিলার’ মুভি ঠিক অভিনব নয়। শুধু পুলিশকেই মুখ্য ভুমিকায় এই প্রথম দেখা যাচ্ছে তাও নয়। কিন্তু এই ঘোষণার ‘এক্সিকিউশন’ আসলেই অভূতপূর্ব। কেননা পুলিশি অপারেশনের এমন নিখুঁত দৃশ্যায়ন বাংলা সিনেমায় একেবারেই বিরল। এতে করে যেমন পুলিশ বাহিনীর ‘ইমেজ’ রক্ষা হলো তেমনি হলে বসে জাগতিক রিয়ালিটিতে বিচরণ করা দর্শকদের পটানোও সহজতর হয়েছে। যদিও কিছুটা দুর্বলতা সিনেমাটিতে যে ছিলনা তা নয়। সিরিয়াস ক্রাইম জোনে ছিঁচকাঁদুনে সাংবাদিকের আবেগঘন অনুরোধ রক্ষা করাটা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার পেশাদারিত্বের বরখেলাপই নয় বড্ড বিপদজনকও। বড় পর্দার খাতিরে তা অবশ্য অবলীলায় এড়ানো যায়। কারণ সত্যিকারের অ্যাকশন থ্রিলার বলতে যা বোঝায় এই সিনেমা তেমনই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও ঝিমিয়ে যায়নি। দর্শককে ডানে বামে তাকানোর সুযোগ না দিয়ে একের পর এক অ্যাকশন ঘটে গেছে। তাই বলে ভাববেন না গোটা সিনেমা জুড়ে কেবল মারপিটের দৃশ্য! তা নয়, সেখানে পুরো সিনেমায় একের পর এক ঘটে গেছে ‘অ্যাকশন’। আর এই অ্যাকশন বলতে আজ অবধি বাংলা ছবির দর্শকের মনে যে মারপিটের একক চিত্র বাঁধাই করা ছিল তাও বদলে দিতে পেরেছে এই সিনেমা।
অ্যাকশনগুলোর সমান্তরালে চলেছে মানবিক গল্প। একদিকে যেমন সন্ত্রাসী তাড়া করছেন সোয়াট কমান্ডার অন্যতিকে তার স্ত্রী মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন প্রসব বেদনার সময়। অবশেষে নতুন মানব শিশু পৃথিবীতে আসা এবং সন্ত্রাসের দমন সমান্তরালে দেখিয়ে পরিচালক দীপন যে শুভত্বের রূপক বার্তা দিয়েছেন, বাংলা সিনেমায় তার সার্থাক রূপায়ন অত্যন্ত বিরল।
সংগীত সংযোজনে ঠিক চমৎকারিত্বের ঝলক না দেখালেও গল্পের আয়োজনে খাপছাড়া হয়নি। বরং পুরোনো একটা জনপ্রিয় গান ‘টিকাটুলির মোড়ে’-কে ‘আইটেম সং’ হিসেবে বেশ মানিয়ে গেছে এখানে। আবার অরিজিৎ-সোমলতার কণ্ঠে ‘টুপ টাপ’ গানটিতে সাবলীল ছিলেন মাহিয়া মাহি, ঠিক যেমনটি অ্যাকশন দৃশ্যে সাবলীল ছিলেন আরেফিন শুভ ও এবিএম সুমন। শেষ গান ‘পথ যে ডাকে’ গেয়েছেন আসিফ ইকবাল। সিনেমা শেষের উত্তেজনা প্রশমনেও বেশ কার্যকরী লেগেছে গানটির উপস্থাপন।
তবে অ্যাকশনের জোয়ারে ভেসে যায়নি সংলাপ এবং কন্টিনিউটির দুর্বলতা। দৃশ্যয়নের পটুতার সঙ্গে দুর্বল সংলাপ সংযোজন সবসময় ঠিকমতো খাপ খায়নি। উত্তেজনার বশে নায়কের মুখ থেকে “এএই” বাদে অন্য কোনো আওয়াজ বের হবে না তা হয়না। আবার চট্টগ্রামের ছোটো চুল ঢাকায় আসতেই ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসবে কারো- তাও বেমানান। এছাড়া দুজন মুখ্য পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগী অন্যান্য কর্মকর্তারা তাদের মতো শারীরিকভাবে ‘ফিট’ কেন হবে না? এরকম খুঁটিনাটি বিষয় পরিচালকের নজর এড়িয়ে গেছে যা পরিণত দর্শকের চোখে কাঁটার মতো বিঁধবে।
পুলিশ সুপার হিরো নয়, দানবও নয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, অন্য দশজনের মতই রক্তমাংসের মানুষ। অথচ প্রজ্ঞা আর কর্মদক্ষতার জোরেই কেবল দুষ্টের দমন সম্ভব। তার প্রমাণ এই সিনেমা। আর হ্যাঁ, সিনেমা হলে দর্শক টানতে দর্শকদের হাতে পায়ে ধরতে হবে না, হুমকি ধামকিও দিতে হবে না। শুধু নিয়মিত বিরতিতে ঢাকা অ্যাটাক বানালেই চলবে।