সাহিত্যকর্ম থেকে, মানে গল্প-উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশ জনপ্রিয়। সেই সাদা-কালো যুগ থেকেই বিভিন্ন দেশে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, এবং দর্শকরাও সে সব চলচ্চিত্র গোগ্রাসে গিলছেন। কারণটাও স্পষ্ট। এগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকরা এমনিতেই কাহিনি নিয়ে প্রস্তুত থাকেন। মানে দর্শকরা অর্ধেক পটে রয়েছেনই, কেবল সেই গল্পের উপস্থাপনটা নিতান্ত দুর্বল না হলেই হলো। এখনো সফল চলচ্চিত্রগুলোর একটা বড় অংশই সাহিত্যকর্ম থেকে নির্মিত। পথের পাঁচালী থেকে শুরু করে আজকের দ্য ভিঞ্চি কোড, এমনকি ফিফটি শেডস অফ গ্রে-র মতো চলচ্চিত্রেরও মূল সাহিত্যকর্ম।
সাহিত্যকর্ম থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের রীতি আমাদের ঢাকার চলচ্চিত্রেও যে একেবারে নেই, তা নয়। বিশেষ করে ঢাকার চলচ্চিত্রের শুরুতেই এই রীতির প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল। পরে উর্দুর সঙ্গে লড়াইয়ে কোণঠাসা হওয়া বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র প্রাণ ফিরে পায় যাত্রাপালা ও ফোক-ফ্যান্টাসির তথা লোকসাহিত্যের কাহিনি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর হাত ধরেই। আর স্বাধীনতার পরের এক-দেড় দশকে সাহিত্যকর্মকে ভিত্তি করে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল।
জাগো হুয়া সাভেরা/ ডে শ্যাল ডন (১৯৫৯)
১৯৫৭ সালে এ জে কারদার ঢাকায় এসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের উদ্যোগ নেন। তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নদীবিধৌত পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরা। তবে আশঙ্কা ছিল, মানিক কোলকাতার এবং হিন্দু লেখক বলে তার উপন্যাস থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র সরকার আটকে দিতে পারে। তাই চলচ্চিত্রের নাম পাল্টে রাখা হয় জাগো হুয়া সাভেরা। আর কাহিনিকার হিসেবে ব্যবহার করা হয় উর্দু সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের নাম।
আনোয়ারা (১৯৬৭)
১৯১৪ সালে প্রকাশিত নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত উপন্যাস আনোয়ারা থেকে ১৯৬৭ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন একই নামের এই চলচ্চিত্রটি। বেহুলা-র পরে জহির রায়হানের এই চলচ্চিত্রেও জুটি বেঁধে কাজ করেন রাজ্জাক-সুচন্দা। অন্যান্যদের মধ্যে অভিনয় করেন আমজাদ হোসেন, চাঁদ প্রবাসী, অরুনা, রহিমা, সবিতা, ওবায়দুল হক সরকার, রানী সরকার, বেবী জামান প্রমুখ। চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ।
তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে, পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটককে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন রোজী সামাদ, প্রবীর মিত্র, কবরী, গোলাম মোস্তফা ও রওশন জামিল। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক ঘটক, ফরিদ আলী, ফখরুল হাসান বৈরাগী, বনানী চৌধুরী, আবুল হায়াত, খলিল প্রমুখ।
বসুন্ধরা (১৯৭৭)
আলাউদ্দীন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন বসুন্ধরা। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট নিবেদিত এই চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেন ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন, নূতন, শর্মিলী আহমেদ ও সৈয়দ হাসান ইমাম। চলচ্চিত্রটি মোট ৬টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)
আমজাদ হোসেন তার নিজের উপন্যাস দ্রৌপদী এখন ট্রেনে থেকে ১৯৭৮ সালে নির্মাণ করেন গোলাপী এখন ট্রেনে। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা, ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা, তারানা হালিম, রওশন জামিল, এটিএম শামসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, টেলি সামাদ প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি দর্শকরাও যেমন গ্রহণ করেছিল, তেমনি সমালোচকদেরও সমাদর লাভ করেছিল।
সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯)
আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৫৫) থেকে ১৯৭৯ সালে শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দীন শাকের যৌথভাবে নির্মাণ করেন একই নামের এই চলচ্চিত্রটি। অভিনয় করেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, সিতারা বেগম, এটিএম শামসুজ্জামান, আরিফুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, ইলোরা গওহর প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি মোট ৭টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়।
রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭)
শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় উপন্যাস শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্বের কাহিনি থেকে ১৯৮৭ সালে বুলবুল আহমেদ নির্মাণ করেন রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত। চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি নায়কের চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেন। তার বিপরীতে রাজলক্ষ্মীর চরিত্রে অভিনয় করেন শাবানা। আরো অভিনয় করেন ইনাম আহমেদ, ঐন্দ্রিলা আহমেদ, অমল বোস, আনোয়ার হোসেন, আনিস, প্রবীর মিত্র, গোলাম মোস্তফা, রাজ্জাক, এটিএম শামসুজ্জামান, বেবী জামান প্রমুখ।
চলবে. . .