যে রাঁধে সে ‘অ্যাকশন’ও বলে…

বিশ্ব চলচ্চিত্রে নারী পরিচালকদের আনাগোনার শুরু চলচ্চিত্রের যাত্রার শুরু থেকেই। চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শুরু ধরা হয় ১৮৯০-এর দশক থেকে। আর বিশ্বের প্রথম নারী পরিচালকের সাক্ষাৎও মেলে সেই দশকেই। তার নাম অ্যালিস গঁ-ব্লেশ। কাজ করতেন ফ্রান্সের গমন্ট ফিল্ম কোম্পানিতে। অ্যালিসের প্রথম চলচ্চিত্র দ্য ফেইরি অব দ্য ক্যাবেজেস মুক্তি পায় ১৮৯৬ সালে। এক মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি পৃথিবীর প্রথম তিন ন্যারেটিভ ফিল্মের একটি। অন্য দুটির একটির নির্মাতা লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় (ক্রেডিটে বড় ভাই লুই লুমিয়েরের নাম দেয়া), অন্যটির নির্মাতা জর্জ মঁলিয়েঁ।

বিশ্বের প্রথম নারী পরিচালক অ্যালিস গঁ-ব্লেশ

পরে অবশ্য পরিচালনার জগতে একাধিপত্য কায়েম করে পুরুষরা। তবে তার মাঝেও বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা সময়ে বহু নারী পরিচালনায় এসেছেন। সংখ্যায় খুবই কম হলেও, তাদের অনেকেই পরিচালনায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিতও করেন। এমনকি এরই মধ্যে চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদার দুই আসর অস্কার ও কানেও সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন নারীরা। কানে প্রথম নারী হিসেবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতেন রাশিয়ার ইউলিয়া সোলনৎসোভা। তাও সেই ১৯৬১ সালে। অবশ্য কানের সেরা পরিচালক হওয়া দ্বিতীয় নারীকে পেতে এরপর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। সোফিয়া কাপোলা সেই অপেক্ষা ঘুচিয়েছেন এ বছরেই। অন্যদিকে অস্কারে এ পর্যন্ত সেরা পরিচালক হয়েছেন মাত্র একজন নারী। ২০০৯ সালে হার্ট লকারের জন্য অস্কারের সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতেন ক্যাথরিন বিগেলো।

জহির রায়হানের উপন্যাস থেকে কোহিনুর আক্তার সুচন্দা নির্মাণ করেন হাজার বছর ধরে

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এই দৃশ্যটা আরো বেশি পুরুষ-ময়। ১৯৫৬ সালে যাত্রা শুরু করলেও, দেশের প্রথম নারী পরিচালককে পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। সে বছর রোজীর পরিচালনায় মুক্তি পায় আশা নিরাশা। চলচ্চিত্রটির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেন মালেক আফসারী। সম্পূর্ণ রঙিন এই চলচ্চিত্রটির পোস্টারে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা ছিল- বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পরিচালকের সাহসী ছবি। সাথে ক্যামেরায় চোখ লাগানো রোজীর একটি ছবিও ব্যবহার করা হয়।

সে অবশ্য এক বিচ্ছিন্ন প্রয়াস। কারণ এরপরে রোজী আর কোনো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেননি। সেই শতকেই সম্ভবত আর কোনো নারী পরিচালিত চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। দ্বিতীয় নারী পরিচালকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে নতুন শতাব্দী আসা পর্যন্ত। তবে এই নতুন শতাব্দীতে এসে দৃশ্যটায় বেশ পরিবর্তনের দেখা মিলেছে। আগের শতকের চার দশকেরও বেশি সময়ে যেখানে নারী পরিচালক পাওয়া গেছে মাত্র একজন, সেখানে নতুন শতকের দুই দশক পেরুনোর আগেই বেশ কয়েকজন নারী পরিচালক সক্রিয় হয়েছেন ঢাকার চলচ্চিত্রে। নিয়মিত তাদের চলচ্চিত্রও মুক্তি পাচ্ছে।

নার্গিস আক্তারের প্রথম চলচ্চিত্র মেঘলা আকাশ

নতুন শতকের নারী পরিচালকদের মধ্যে প্রথম পরিচালনায় নামেন নার্গিস আক্তার। তার প্রথম চলচ্চিত্র মেঘলা আকাশ মুক্তি পায় ২০০১ সালে। এরপর এক-এক করে তার আরো চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে- চার সতীনের ঘর (২০০৫), মেঘের কোলে রোদ (২০০৮), অবুঝ বৌ (২০১০) এবং পৌষ মাসের পিরিতি (২০১৬)। পরে নারী পরিচালকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন সামিয়া জামান, রুবাইয়াত হোসেন এবং গীতালি হাসান। এ পর্যন্ত সামিয়া জামানের দুটো চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে- রাণীকুঠির বাকি ইতিহাস (২০০৬) এবং আকাশ কত দূরে (২০১৪)। রুবাইয়াত হোসেনের দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও, সমালোচনার মুখে তার প্রথম চলচ্চিত্র মেহেরজান-এর (২০১১) পরিবেশনা এক সপ্তাহের মাথায় বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ২০১৫ সালে মুক্তি পায় তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র আন্ডার কনস্ট্রাকশন। আর নাট্যনির্মাতা হিসেবেই বেশি পরিচিত গীতালি হাসানের প্রথম চলচ্চিত্র প্রিয়া তুমি সুখী হও মুক্তি পায় (২০১৪) সালে।

সমালোচনার মুখে মেহেরজান-এর (২০১১) পরিবেশনা বন্ধ করে দেয়া হয়

অন্যদিকে রোজীর মতো বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত নায়িকাও এ শতকে এসে পরিচালনায় নাম লিখিয়েছেন। তারা অবশ্য ঠিক নিয়মিত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন না। তাদের মধ্যে প্রথম পরিচালনায় নাম লেখান মৌসুমী, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩) এবং মেহের নেগার (২০০৫) দিয়ে। পরে ২০০৫ সালে কোহিনুর আক্তার সুচন্দা তার প্রয়াত স্বামী জহির রায়হানের উপন্যাস থেকে নির্মাণ করেন হাজার বছর ধরে (২০০৫)। তার পরের বছর কবরী নির্মাণ করেন আয়না (২০০৬)। এই তালিকায় সর্বশেষ নাম লিখিয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন। সুচন্দার মতো তিনিও তার প্রয়াত স্বামীর সাহিত্যকর্মকে চলচ্চিত্রায়িত করেন। ২০১৬ সালে হুমায়ুন আহমেদের একই নামের উপন্যাস থেকে তিনি নির্মাণ করেন কৃষ্ণপক্ষ। বর্তমানে তিনি হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস থেকে আরেকটি চলচ্চিত্রের কাজ করছেন, নাম নক্ষত্রের রাত

বাংলাদেশের প্রথম নারী পরিচালিত চলচ্চিত্র আশা নিরাশা

এছাড়াও বেশ কয়েকজন নারী ডকুমেন্টারি নির্মাতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নারী পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন শবনম ফেরদৌসী। তার প্রামাণ্যচিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষাজয়িতা, জন্মসাথী, অপেক্ষা, নহ মাতা নহ কন্যা, একটুখানি প্রাণের খোঁজে প্রভৃতি। এছাড়াও ভাষাশহীদ আবুল বরকতকে নিয়ে রোকেয়া প্রাচী ২০১০ সালে বায়ান্ন মিছিলে নামে একটু গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। আর ২০১৫ সালে তিন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে বিষকণ্ঠ নামের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ফারজানা ববি।