রংবাজ : এ কোন দেশের রংবাজি?

এই কোরবানির ঈদে মুক্তি পেয়েছে শাকিব খান-শবনম বুবলি জুটির তৃতীয় (বা চতুর্থ) চলচ্চিত্র রংবাজ। না, চলচ্চিত্রটির সঙ্গে নায়করাজের রংবাজের কোনো সাদৃশ্যই নেই, নামটুকু ছাড়া। তবে এই নতুন রংবাজ মুক্তি নিয়ে সত্যি সত্যিই অনেক রংবাজি হয়েছে। সে সবের ফলাফল হিসেবে রোজার ঈদের বদলে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে কোরবানীর ঈদে।

তাতে অবশ্য আখেরে রংবাজের লাভই হওয়ার কথা। কারণ এই ঈদে বাজার যে অনেকটাই ফাঁকা। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুটো ছবি থাকলেও, শাকিব-বুবলি জুটির অহংকার আর পপি-পরিমনি ও ডিএ তায়েবের সোনা বন্ধু, এর কোনোটাই ঠিক ঈদের ছবি নয়। সব মিলিয়ে তাই এই ঈদের বাজারে সবচেয়ে রমরমা অবস্থা যাচ্ছে রংবাজের।

শাকিব খানের সুদর্শন লুকের সঙ্গে মানিয়েছে সুন্দর পোশাক-পরিকল্পনায় সুশ্রী বুবলিকে

অবশ্য এই ঈদে চলচ্চিত্রের বাজার গত কয়েক ঈদের তুলনায় তেমন জমেনি। সেই না-জমা ঈদের বাজারের সবচেয়ে রমরমা সিনেমা রংবাজের অবস্থাও তেমনই। এমনিতে সিনেমাটাতে রংচঙ ঝাঁ-চকচকের কমতি নেই। নায়ক-নায়িকার চেহারা-সুরতও সুন্দরই দেখিয়েছে। শাকিব খানের লুকের উন্নয়ন এখানেও বজায় থেকেছে। সুন্দর পোশাক-পরিকল্পনায় সুশ্রী বুবলির রূপের আরো খোলতাই হয়েছে। গানগুলোও দেখতে-শুনতে ভালো। অন্যতম খলনায়ক অমিত হাসানের ভালো অভিনয়ের পাশাপাশি তার সংলাপে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ও তার গান-কবিতার উদ্ধৃতিগুলোও ভালো মানিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও, সিনেমাটা খুব বেশি জমেনি।

অমিত হাসানের সংলাপে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ও তার গান-কবিতার উদ্ধৃতিগুলোও ভালো মানিয়েছে

সিনেমাটা না-জমার বড় কারণ এর গল্প। সম্প্রতি ঢাকার চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনি ভয়ংকরভাবে তামিল-তেলেগু চলচ্চিত্রের ফর্মুলাকে ভিত্তি করে নির্মিত হচ্ছে। কেবল সেখানকার ফর্মুলাই নয়, তামিল-তেলেগু প্রভৃতি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের চলচ্চিত্রগুলোর গল্পগুলো থেকেই ঢাকার চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছে। তাতে একটা সমস্যা দিনকে দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। যেহেতু ওই অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি একরকম নয়, ব্যাপারগুলো যতই হাসি-মশকরার বলে চালানো হোক আর যতই উপভোগ্য বলে মনে হোক, দিন দিন আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের গল্প থেকে দূর-থেকে-দূরে চলে যাচ্ছে।

এই যেমন রংবাজে যে সব রংবাজি দেখানো হলো, তার কোনোটাই কি বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে যায়? নায়কের পরিবারের ইতিহাসটা যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাকে ভীষণ আপত্তিকর ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! নায়কের মায়ের সমস্ত সংগ্রাম ছেলেকে জাতীয় রংবাজ বানানোর। কারণ সেটা নাকি তাদের খানদানের ঐতিহ্য! তার দাদা ছিল এলাকার বড় রংবাজ, তার বাবা ছিল শহরের সেরা রংবাজ, তাই নায়ককে হতে হবে জাতীয় রংবাজ! আর জাতীয় রংবাজ হয়ে তার ছেলে তার স্বামী-হত্যার বদলা নেবে! এই ধরনের স্বামী (কিংবা পিতা বা অন্য কারো) হত্যার বদলা নিতে ছেলেকে খুনি বানানোর বিংশ-শতকীয় ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের গল্প থেকে ঢাকার চলচ্চিত্রের বের হয়ে আসাটা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

নায়কের মায়ের সমস্ত সংগ্রাম ছেলেকে জাতীয় রংবাজ বানানোর

এই রংবাজি ধরনের সংস্কৃতির সাথে খানিকটা সাদৃশ্য আছে পুরান ঢাকার জীবনযাত্রার। সেই সাদৃশ্যের কারণে এর আগেও পরিচালক শামীম আহমেদ রনির বসগিরি-র কাহিনি পুরান ঢাকাতে স্থাপন করা হয়েছিল। এবারও তাই করা হয়েছে। একই কারণে সম্ভবত পরিচালক আগামীতেও প্রচুর সিনেমার প্রেক্ষাপট হিসেবে পুরান ঢাকাকে বেছে নেবেন। তবে সেক্ষেত্রে এটাও মনে রাখা জরুরি, পুরান ঢাকায় কাহিনি স্থানান্তর করলে তার সব উপকরণ-সমেতই পুরান ঢাকায় স্থাপন করা দরকার। কেবল পুরান ঢাকার মুখের ভাষা আর একটা বাড়ির সেট দেখানোতেই কাজ সারা উচিত নয়। বিশেষত সিনেমাটা বানাতে গিয়ে যেহেতু বাজেট নিয়ে খুব একটা সমস্যা পোহাতে হয়েছে বলে মনে হয়নি।

পুরান ঢাকার মুখের ভাষা আর একটা বাড়ির সেট দেখানোতেই পুরান ঢাকায় কাহিনি স্থানান্তর হয় না

সিনেমাটিতে আরো অনেক গুরুতর অসঙ্গতি দেখা গেছে, যেগুলো এড়ানো খুবই জরুরি ছিল। এই যেমন একজন ডাক্তারের মেয়ে কেবলই নাচের স্কুল চালায়, আর কিছুই করে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব এই ব্যাপারটা যদিও কষ্টে-সৃষ্টে বিশ্বাস করা গেল, কিন্তু তার কোনো নাচ দেখেই তাকে নৃত্য-পটিয়সী হিসেবে বিশ্বাস করা গেল না। এমনকি নায়কের সাথে নাচের চ্যালেঞ্জে নেমে, কঠিন নাচ নাচিয়ে নায়কের হাত-পা ভেঙে দেবার কথা ভেবে সে এমন সব নাচ নাচল, এবং নায়কের যেই নাচ নাচতে না পেরে সে হেরে গেল, তার সবগুলোই নিতান্ত নৃত্য-অপটিয়সীর পক্ষেও নাচা সম্ভব। কেবল সালসা নামের বিদেশি ও জনপ্রিয় নাচের নাম বলার মাধ্যমেই নায়িকাকে নাচের শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটা ঠিক জুতসই কর্মপন্থা নয়।

মানে নায়িকার মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রই ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। অন্যান্য চরিত্র ঘাঁটতে গেলে এমন আরো দুর্বলতার উল্লেখ করা সম্ভব। কেবল চরিত্র-প্রতিষ্ঠাতেই নয়, ফাঁক আছে গল্পেও। যেমন নায়কের মা জানতো যে, ডাক্তার মান্নান তথা নায়িকার বাবা একদা নায়কের বাবাকে খুন করেছিল। অথচ সে যেভাবে নায়িকার বাবাকে খুনি হিসেবে জানলো, সেটা নিছকই এক হাস্যকর প্রক্রিয়া। আর তারচেয়েও অবাক-করা ব্যাপার, নায়কের বাবা ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নায়ককে সে ছোটবেলায় ভালো করেই চিনত, কিন্তু নায়কের মা বলার আগে সে নায়ককে চিনতেই পারলো না! অথচ এমনও তো না যে, নায়কের স্বভাব-চরিত্রের বা নামের খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে। সে রংবাজ বাবার রংবাজ সন্তান। ছোটবেলায় তার যে নাম ছিল, এখনো তাই আছে। অবশ্য ডাক্তারের বিদেশে লম্বা সময় কাটানো দিয়ে তার বিপরীতে এক ধরনের ধামাচাপা-দেয়া-ধরনের যুক্ত দেয়া হয়েছে।

নাচের শিক্ষক হলেও নায়িকা যে নৃত্য-পটিয়সী তার প্রমাণ সিনেমায় নেই

তবে চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় বোধহয় নায়কের নামকরণ। এর আগে শাহরুখ খানের মাই নেম ইজ খান সিনেমার নাম নিয়ে শাকিব খানকে নায়ক করে সিনেমা বানানো হয়েছিল। নাম ছাড়া সিনেমা দুটোর আর কোনো মিল অবশ্য ছিল না। এবার শাকিব খান অভিনীত নায়কের চরিত্রের নাম নেয়া হয়েছে বলিউডের আরেক খানের থেকে ধার করে। রংবাজের নায়ক চরিত্রটি আবার ওই খান সচরাচর যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন, সেই ধরনেরই। তাই হয়তো চরিত্রটির নাম দেয়া হয়েছে সাল্লু। কাল্লু রংবাজের ছেলে সাল্লু রংবাজ। তার প্রেমে পরে ডাক্তারের মেয়ে বুবলি আবার হয়ে যায় বুল্লু রংবাজ।

রংবাজ বাবার রংবাজ ছেলে প্রেম করে ডাক্তারের মেয়ের সাথে

বাকি রইল বলিউডের আর একজন মাত্র খান। রূপালি পর্দায় কবে সেই আমির খানের নাম-ধাম শাকিব খানের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয়, এবার যেন তারই অপেক্ষা। অন্তত পরিচালকরা যতদিন বুঝতে না পারছেন, ওপারের তিন খানের বিপরীতে এপারে একটাই মাত্র খান, তত দিন গল্পের মতো নায়কের নাম-ধামেও এই অনুকরণের দোষ বোধহয় থাকবেই।