১৯৭৪ সালে মাসুদ রানা চলচ্চিত্র দিয়ে অভিষেক ঘটে পরিচালক মাসুদ পারভেজ ও নায়ক সোহেল রানার। এই দুইজন আদতে একই ব্যক্তি। এবং ওই একই চলচ্চিত্র দিয়ে অভিষেক ঘটে মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পারভেজ ফিল্মস-এরও। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে পরে অভিষেক হয়েছিল সোহেল রানার ভাই মাসুম পারভেজ ওরফে রুবেলেরও, ১৯৮৬ সালে, লড়াকু চলচ্চিত্র দিয়ে।
২০১৪ সালে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানার থেকেই অভিষেক হয় সোহেল রানার ছেলে মাশরুর পারভেজ ওরফে ইয়ুল রাইয়ানেরও। সিনেমার নাম ছিল অদৃশ্য শত্রু। বাবার মতো তিনিও দুই পরিচয়ে গ্রহণ করেন দুই নাম। পরিচালক মাশরুর পারভেজ ও নায়ক ইয়ুল রাইয়ান। তবে বাবা যেমন নতুন ধরনের চলচ্চিত্র নিয়ে বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, দেশের অন্যতম নায়ক হিসেবে দ্রুতই নিজের আসন পাকা করে নিয়েছিলেন, পুত্রের যাত্রা ঠিক উল্টো পথে। আর সে উল্টো যাত্রার ব্যাপারটা নিশ্চিত করলেন তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র রাইয়ান দিয়ে।

অদৃশ্য শত্রু সব মিলিয়ে মোটে ৩০টা হল পেয়েছিল। গত মাসে মুক্তি পাওয়া রাইয়ান-এর অবস্থা আরো করুণ। সিনেমাটির হল পাওয়ার কথাই ছিল মাত্র ১০টা। কিন্তু এর আগেই মুক্তি পাওয়া ভয়ংকর সুন্দর-এর ব্যর্থতা সেই হলসংখ্যা নামিয়ে আনে মাত্র ৪-এ। এই কম হল পাওয়ার কারণটাও পরিস্কার। চলচ্চিত্রটিতে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রায় কোনো ফর্মুলারই স্থান হয়নি। কাহিনি ফর্মুলা ভিত্তিক নয়। অনেকগুলো নারী চরিত্র থাকলেও, সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত কোনো নায়িকা নেই। আইটেম সং দূরে থাক, কোনো বাংলা গানই নেই।
চলচ্চিত্রটিতে মূলত দুটো গল্প বলা হয়েছে। কাহিনিতে একজন লেখককে নিয়ে এসে, তার গল্প বলে এই দুটো গল্পকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমটি একজন সিরিয়াল কিলারের গল্প। স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা এই সিরিয়াল কিলার দিনের বেলা ডাক্তার জেকিলের মতো স্বাভাবিক একজন, যে প্রচুর সিনেমা দেখে। আর রাতের বেলা সে হয়ে যায় মিস্টার হাইডের মতো অসুস্থ দানব। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে সে। এই ডিসঅর্ডারের জন্য তার স্বাভাবিক স্বত্বার মধ্যেও নানা ধরনের অসঙ্গতি দেখা দেয়। চিন্তিত হয়ে পরে তার গার্লফ্রেন্ড। একের পর এক মেয়েদের রহস্যজনক খুনের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। ধরা পরে সেই সিরিয়াল কিলার- যার ডাক্তার জেকিল স্বত্বার নাম মাশরুর আর মিস্টার হাইড স্বত্বার নাম রাইয়ান।
প্রথম গল্পটি বেশ গোছানো হলেও, তুলনায় দ্বিতীয় গল্পটা অনেকটাই এলোমেলো। গল্পটি একজন চোরাচালানকারী গডফাদারের প্রধান সহযোগী রাইয়ানকে কেন্দ্র করে। গডফাদারকে ঘায়েল করার জন্য প্রতিপক্ষ মিস্টার বোবো দলে ভেড়ায় গডফাদারের দলের এক সদস্যকে। অন্যদিকে রাইয়ানের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় এক কলগার্লের। মিস্টার বোবো গডফাদারের কাছে সমঝোতার প্রস্তাব পাঠালে, গডফাদার তাতে সম্মত হয় না। ঝুঁকি বিবেচনা করে তিনি রাইয়ানকে তার মেয়ে রনকির নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন। কিন্তু মিস্টার বোবো যেহেতু ‘পাতায় পাতায় চলে’, তাই সে রনকির বদলে রাইয়ানের ঘনিষ্ঠ হওয়া কলগার্লকে খুন করে। প্রতিশোধ নিতে রাইয়ানও খুন করে তাকে।

এই দুটো গল্পকে জুড়ে দেয়া হয়েছে এক লেখককে দিয়ে। তার নামও রাইয়ান। সে একটা বারে আসে এক চিত্রপরিচালককে তার গল্প শোনাতে। তাকে সে প্রথম গল্পটি শোনায়। গল্পটির প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এই পরিচালক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দর্শকদের ‘অশিক্ষিত’ও বলে। মূল পরিচালক আবার তার প্রতিবাদ করেন। তবে এই পরিচালকের মুখে ‘অশিক্ষিত দর্শক’ শব্দবন্ধ উচ্চারণ করানো এবং দেশের দর্শকদের শিক্ষিত প্রমাণের জন্য প্রথম গল্পটির পুরোটুকুতে চরিত্রগুলোর মুখে বিশুদ্ধ ইংরেজি সংলাপ বসিয়ে দেয়াটা ভীষণই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এই সময়ে প্রায়ই সন্দিহান হতে হয়েছে, এটি কি আদৌ কোনো বাংলা চলচ্চিত্র!
এই ইংরেজি সংলাপের আরো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে। দাবি করা যেতে পারে, যেহেতু তথাকথিত হাই ক্লাস সোসাইটির গল্প বলা হচ্ছে, তাদের প্রবণতা হিসেবেই চরিত্রগুলো কেবল ইংরেজিতেই কথা বলে গেছে। কিন্তু তা দিয়ে চলচ্চিত্রটির আগাগোড়া সংলাপের দুর্বলতার সাফাই গাওয়া যায় না। এই সংলাপই চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে দুর্বল অনুষঙ্গ। ইংরেজি সংলাপগুলো অবশ্য মন্দ হয়নি। কারণ গল্প টুকলি করা না হলেও, বিভিন্ন ইংরেজি চলচ্চিত্র থেকে দেদারসে সংলাপ টুকলি করা হয়েছে। কিন্তু যখনই বাংলায় সংলাপ দেয়া হয়েছে, প্রায়শই সেগুলো ভীষণ রকমের দুর্বল। সম্ভবত চরিত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইয়ুল রাইয়ান লেখক এবং দুই গল্পে উদ্ভটভাবে সংলাপ বলেছেন, যেটা সংলাপের এই দুর্বলতাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অথচ একদম শেষে ছোট্ট একটা গল্প বলে যখন সিনেমা শেষ করা হলো, তাতে তার সংলাপ-উচ্চারণে অমন জটিলতা দেখা যায়নি।
সাধারণত বাংলাদেশে একক ঘরানার কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না। একই চলচ্চিত্রে একটু অ্যাকশন, একটু ড্রামা, খানিক ক্রাইম-থ্রিলার ইত্যাদি মিশিয়ে উদ্ভট একটা মিশ্র-ঘরানার সৃজন করা হয়। সে ধারারও একদম বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাইয়ান কেবলই একটা থ্রিলার। সে জন্য গল্প এমনভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে দর্শক কখনোই স্বস্তিবোধ করে না। সিনেমাটোগ্রাফিরও মূল প্রবণতা ওই একই। দর্শককে সবসময়ই হয় কাহিনি দিয়ে নয় ক্যামেরা দিয়ে এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে রাখা হয়েছে। তা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে পরিমিতি ও পরিণতির অভাব পরিলক্ষিত হলেও, প্রচেষ্টা হিসেবে এর প্রশংসা করা যেতে পারে।

তবে রাইয়ান-এ সংলাপের সময় তো তবু মাঝেমধ্যে মনে হয় এটা বাংলা চলচ্চিত্র। কিন্তু গান বিবেচনায় নিলে এটাকে কখনোই বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র মনে হয় না। চলচ্চিত্রটির গানগুলোর একটিও বাংলা নয়। এমনকি গল্পগুলোর ভিত্তিতে সিনেমাটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ‘ফিরে আসা’ শীর্ষক শেষ ভাগ বাদ দিলে বাকিগুলোর নামও রাখা হয়েছে ইংরেজিতে। চলচ্চিত্রটির এই বাংলা-বিমুখিতা এড়ানো গেলে, এটিকে একটা ভালো থ্রিলার-প্রচেষ্টা হিসেবেই বিবেচনা করা যেত।