চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

কেমন হতো, যদি সেদিন মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে ফেরার পথে দুজনের যাত্রা চিরতরে থেমে না যেত? যদি কোনোভাবে হতো না সেই দুর্ঘটনা? যদি…
আঘাতটা এড়ানো যায়নি। সময় এক দাগ বসিয়ে দিয়ে ছুটে চলে গেছে, চলছে তুমুল গতিতে। পুরো ৬ বছর পেরিয়ে গেল তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের চলে যাওয়ার, ১৩ আগস্ট আজ। ২০১১ সালের এই দিনে কেবল তাদের মৃত্যু নয়, অনেকগুলো সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে চিরতরে।
এই সম্ভাবনার শুরু দেখতে গেলে কয়েক দশক পেছনের দিকে যেতে হবে। আশির দশক। একঝাঁক তরুণ তখন তুখোড় সব স্বপ্ন নিয়ে সাজিয়েছিলেন, সিনেমার চেহারা বদলে দেবেন। কেবল সৃষ্টির শিল্প নয়, সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম। কাজের শুরু ছোট ছবি নিয়ে, যাকে আমরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলি। দুজনের জুড়ি মিলে যাবার গল্প তখন থেকেই। এস.এম.সুলতানকে নিয়ে তথ্যচিত্রের দু:সাহস। বাকিটা ইতিহাস—যার রচনা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর করেছিলেন।  সিনেমা নিয়ে আরও কত কত চিন্তা আর কাজ দুজনের তখন থেকে।
সেই সময় পেরোবার পর দুজনেই নিজ নিজ স্থান নিয়ে মনোযোগী হয়েছেন। অনেক কিছুর শুরুই নয় কেবল, নিজেদের পেশাদার ক্ষেত্রেও হয়ে উঠেছেন সফল মানুষ। তারেক মাসুদ সিনেমা নিয়ে, মিশুক মুনীর সাংবাদিকতায়। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের আইকনিক শিক্ষক ছিলেন তিনি, হাতে কলমে (পড়ুন ক্যামেরায়) শিখিয়েছেন ভিডিও জার্নালিজম, সেটা ১৯৯৫ এর পরের কথা। ওদিকে তারেক মাসুদ দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের ছবিও অস্কার যেতে পারে! ১৯৫৯ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র পর ‘মাটির ময়না’ উড়াল দিলো সিনেমাজগতের অভিজাততম দরবারে, টাইমলাইন ২০০২। এরপর লিয়ার লেভিনের ‘মুক্তির গান’ মুক্ত হলো।
দুজনের বন্ধুত্ব ছিল দারুণ। তাই বহু ব্যস্ত সময় আর শিডিউলের চাপ ফাকিঁ দিয়েও ‘নরসুন্দর’ নিয়ে আবারো যাত্রা। এরপর ‘রানওয়ে’, ২০১০ সালে। আরো একটি যাত্রার পথ তৈরি হচ্ছিল সামনে— ‘কাগজের ফুল’। স্বাধীনতা, যুদ্ধ, ধূসর কিংবা প্রদীপ্ত বর্তমান; সব ছাপিয়ে এবারের গল্প ছিল দেশ ভাগ নিয়ে। সেই গল্পের পরিণতি আমাদের দেখা হয়নি, বদলে এক নির্মম আঘাত। এক দ্রুতগতির এক যান নিমেষে কেড়ে নিলো সবকিছু, সাথে সাথে স্তব্ধ হয়ে গেল এদেশের সিনেমার অজস্র সম্ভাবনা।
অসমাপ্ত তারেক মাসুদ, অসমাপ্ত মিশুক মুনীর—কিছু কিছু অসমাপ্ত গল্প দীর্ঘশ্বাসেও সুন্দর হয়ে থাকে। তবে এই অসমাপ্ত গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো, এই খেদ আমাদের কোনোদিন ফুরোবে না।