টিকে থাকার মহাকাব্যিক উপাখ্যানঃ নোলানের ‘ডানকার্ক’

শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। প্রায় শতবর্ষ পরে এসে এই অগাস্টেই অপরাজেয় কথাশিল্পীকে ভুল প্রমাণ করলেন মেমেন্টো, ইনসেপশন আর ইন্টারস্টেলারের পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান নিজের নতুন সিনেমা ‘ডানকার্ক’ দিয়ে।

সময়টা ১৯৪০। হিটলারের নাজি বাহিনীর তাড়ায় ফ্রান্সের সমুদ্রতীরবর্তী শহর ডানকার্কের সৈকতে জড়ো হয়েছে চার লক্ষাধিক ব্রিটিশ, ফরাসি, বেলজীয় ও ডাচ সেনা। দ্রুত এগিয়ে আসছে হিংস্র জার্মান বাহিনী, সারি বেঁধে তীর্থের কাকের মতো লক্ষ লক্ষ পরাস্ত সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায়- মাঝখানে মাত্র ২৬ মাইলের ইংলিশ চ্যানেল, বাড়ি যেন এখান থেকেই দেখা যায়! কিন্তু উদ্ধারকারী সামরিক জাহাজের হদিস নেই, আকাশ অদেখা হয়েছে আক্রমণ আর প্রতিরোধের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায়।

উদ্ধার পাওয়া অনামা নাবিকের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন কিলিয়ান মারফি

ডানকার্ক, এক অতিমানবীয় ব্রিটিশ উদ্ধার অভিযানের কাহিনী। ব্যাটম্যানকে নতুন করে চেনানো নোলান এই শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযানকে দর্শকের কাছে পৌঁছেছেন একই সাথে তিন মাত্রায়- মাটি, পানি আর আকাশে। সময়েরা খেলা করেছে নিজ নিজ পরিধিতে। মাটি, অর্থাৎ সৈকতে জড়ো হওয়া পলাতক সৈন্যদের চোখ দিয়ে, যে লড়াইয়ের ব্যাপ্তি সাত দিন; সমুদ্রের অংশে- যুদ্ধজাহাজ আর ব্যক্তিগত জলযানের এক দিনের উদ্ধার তৎপরতা; আর আকাশে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের সাথে লুফৎয়াফের এক ঘণ্টার এক ডগফাইটে। তিন দিকের পরিপ্রেক্ষিত একান্ত নিজ নিজ গতিতে এগিয়ে মিলেছে এক বিন্দুতে।

কিন্তু সিনেমার শুরুটা অসম্ভব শান্ত সমাহিত ভাবে। জনশূন্য রাস্তা ধরে ইতস্তত হাঁটছে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা। আকাশ থেকে কনফেত্তির মতো তাদের মাথার উপর ঝরে পড়ছে কাগজের টুকরো। একজন তার একটা তুলে নিতে দেখা গেল সেটি একটি লিফলেট, যাতে ছবি দিয়ে চিহ্নিত করা আছে জার্মান বাহিনীর অগ্রগতি- ডানকার্ক শহরের কাছে মিত্রবাহিনীর সব অংশকেই ঘিরে ফেলেছে তারা, বাকি আছে শুধু এক টুকরো সৈকত, যেথায় অপেক্ষমান চার লক্ষ সৈন্য।

দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন টম হার্ডি

এরপরেই শুরু হল ধাওয়া আর যুদ্ধের তাণ্ডব, উত্তেজনার পারদ যা সিনেমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বহাল রইল। সৈকতের অংশে অপেক্ষারত সৈন্যদের প্রধান প্রতিনিধি টমি (ফিওন হোয়াইটহেড)। এ সিনেমা দিয়েই তাঁর অভিষেক। নতুন মুখ নেয়ার পেছনে নোলানের কারণ ছিল চরিত্রটি যেন অজস্র সৈন্যের একজন হিসেবেই রূপায়িত হয়, বিশেষ কেউ হিসেবে নয়। শুরুর দৃশ্যে জার্মান আক্রমণ থেকে বেঁচে আসা একমাত্র সৈন্য টমি। সৈকতে এসে সে পায় গিবসনকে (অ্যানিউরিন বার্নার্ড), মৃত এক সৈন্যকে মাটি চাপা দেয়ার সময়। দুজনেরই লক্ষ্য জাহাজে ওঠার জেটি পর্যন্ত পৌঁছানো, যার দায়িত্বে আছেন ন্যাভাল কমান্ডার বোল্টন (কেনেথ ব্রানা) এবং আর্মির কর্নেল উইন্যান্ট (জেমস ডার্সি)। প্রথম চেষ্টায় টমি আর গিবসন জাহাজে নিজেদের জায়গা করতে ব্যর্থ হলে জেটিতেই লুকিয়ে তারা অপেক্ষা করে পরবর্তী সুযোগের জন্য। ঘটনাক্রমে তাদের সাথে যুক্ত হয় অ্যালেক্স (ব্রিটিশ পপস্টার হ্যারি স্টাইলস)। একের পর এক প্রাণান্ত চেষ্টা, আশাভঙ্গ আর ব্যর্থতার চেহারায় অলৌকিক উদ্ধারের আবর্তে সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যকে আলাদা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে দর্শকদের পক্ষে।

সাগরের গল্পের মূল চরিত্র মিস্টার ডসন (অস্কারজয়ী মার্ক রাইল্যান্স)- রয়্যাল নেভির আদেশে ব্যক্তিগত জলযান নিয়ে আরও অসংখ্য অসামরিক মানুষের সাথে বিনা প্রশ্নে যিনি যোগ দিয়েছেন উদ্ধার অভিযানে, সাথে ছেলে (টম গ্লিন-কার্নি) আর আবেগের বশে চলে আসা সাহায্যকারী এক কিশোর (ব্যারি কিওঘান)। ডানকার্কের দিকের যাত্রায় তারা উদ্ধার করে টর্পেডোর আঘাতে ডুবন্ত জাহাজের অনামা এক সৈন্যকে। আতঙ্কের ঘোর তার দুচোখে, যে দুঃস্বপ্ন থেকে সে কোনোদিন মুক্তি পাবে কিনা সন্দেহ। এই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন কিলিয়ান মারফি, যার চরিত্রের নাম পুরো সিনেমায় একবারও উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য প্রয়োজনও ছিলনা, যুদ্ধের ভয়াবহতাই ভাষা দিয়েছে জাহাজের নাবিককে।

প্রতীক্ষা কেবল সাগর পাড়ি দেওয়ার

তিন আকাশযোদ্ধার একজনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অদ্বিতীয় টম হার্ডি, তাঁর চরিত্রের নাম ফ্যারিয়ার। নিজেদের তিনটি স্পিটফায়ার ফাইটার প্লেনের বহর নিয়ে জার্মান বম্বার বিমান বহরকে প্রতিরোধ ও সম্ভব হলে ধরাশয়ী করার দায়িত্ব নেওয়ার গল্প বলেছেন নোলান। নীল আকাশে দুর্বার গতিতে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া, নিচে উথাল পাথাল সাগর, নখ কামড়ানোর মতো শ্বাসরুদ্ধকর একেকটা আক্রমণ- এককথায় ভয়ঙ্কর সুন্দর। টম হার্ডি প্রায় পুরোটা সময় চোখের অভিব্যক্তিতেই অসামান্য অভিনয় করেছেন।

হান্স জ্যিমারের সুর সংযোজনের কথা না বললে ডানকার্কের অসাধারণত্ব পুরোপুরি বলা হয় না। এ সিনেমায় সংলাপের জায়গা নিয়েছে এক দিকে অভিব্যক্তি, আরেক দিকে সুর- ঘড়ির টিক টিকে ফুরিয়ে যেতে থাকা সময়ের আভাস, তাতে মিশে থাকা অপেক্ষার অসহনীয়তা, একই সাথে প্রতি মুহুর্তে বাঁচা মরার নির্মম জুয়ার দম আটকানো উত্তেজনা- সিনেমার ১০৬ মিনিটের পুরোটা জুড়েই উৎকর্ণ করে রাখে দর্শককে।

কিন্তু যুদ্ধ, ডগফাইট, দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর- এসবতো আরও দু-দশটা যুদ্ধের সিনেমায় থাকে, ডানকার্কের বিশেষত্ব কোথায়? যুদ্ধছবি হিসেবে কেন এটি আলাদা? ডানকার্কের অসাধারণত্ব হলো এই সিনেমায় কোন ‘একজন’ নায়ক নেই; কোন একক ব্যক্তি, আখ্যান, আবেগ বা বীরত্বের জয়গান নেই। গরম গরম সংলাপ নেই। গুরুত্ব এখানে ‘এককে’ নয়, ‘একত্রে’, নায়ক এখানে ‘টিকে থাকা’, ‘জয়’ নয়।