হুমায়ূন আহমেদের মূল পরিচয় লেখকের- মূলত ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার হিসেবে। মোটা দাগে বললে, সাহিত্যিক। এই সাহিত্যিক পরিচয়টুকু বিবেচনায় নিলে আবার এটা মনে রাখাও জরুরি, বর্তমান সময়ের জটিলতম সাহিত্যমাধ্যমের নাম চলচ্চিত্র। এই একটি মাধ্যমের মোহনায় মেশে আর সব সুকুমার মাধ্যম। সম্ভবত সেকারণেই নজরুল থেকে শুরু করে মার্কেজ সবাই নিজেদের নানা ভাবে যুক্ত করেছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। আজীবন সিনেমার পোকা হুমায়ূন আহমেদও ছিলেন এই দীর্ঘ তালিকায়, নিজস্ব উজ্জ্বলতা নিয়েই।
গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল। তবে তিনি স্রেফ রোমাঞ্চের খোঁজে বা শৈল্পিক অভিযাত্রার স্বাদবদল করতে সেলুলয়েডের জগতে আসেননি। বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক চলচ্চিত্র নিয়েও ভেবেছেন আর সেজন্যই এসেছিলেন পরিচালনায়। নইলে তার কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ তো হচ্ছিলই। সেগুলোর বাবদে তার কপালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও জুটেছিল। আর লাভ তো বেশি হচ্ছিল টিভি-নাটক লিখেই। নাটকে তার হাতে-গড়া চরিত্রের মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে যখন তখন মানুষ রাস্তায় নামে, এরচেয়ে বড় সার্থকতা একজন লেখকের জীবনে আর কী হতে পারে!
এভাবে সাহিত্যকর্মকে পাঠকদের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারাটাই ছিল তার সাহিত্যকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার মতো পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক গোটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই বিরল। সব মিলিয়ে তার জন্য নতুন করে চলচ্চিত্রে নাম লেখানোটা মোটেই জরুরি ছিল না, কোনো অজুহাতেই। তবে ঘটনাটা ঢাকার চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করেছিল লাইফলাইনের মতো।
তিনি যখন নিজের প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি নির্মাণ করলেন, বলা যায় সেটা তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নির্মাণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের কথা অবদমিত থাকার পর, সুযোগ মিলতেই তিনি রূপালি পর্দায় ভীষণ আবেগে ফুটিয়ে তুললেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তবে তার নিয়মিত পরিচালনার শুরু শ্রাবণ মেঘের দিন থেকে। সেটা নব্বই দশকের শেষ ভাগের কথা। ততদিনে ঢাকার চলচ্চিত্রের গেঁড়ে বসেছে অশ্লীলতা। মানে ঢাকাই চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত পতনের সূচনা হয়ে গেছে।
সেই সময়ে ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করার ঝুঁকি হুমায়ূন আহমেদ না নিলেও পারতেন। তত দিনে তিনি বিপুল জনপ্রিয়। কেবল বই লিখেই দুই হাতে টাকা কামাচ্ছেন। দেশ জোড়া তার খ্যাতি, দেশ জোড়া গ্রহণযোগ্যতা। ঈর্ষাকাতর কিছু লেখক ছাড়া সারা দেশের সকল মানুষ তাকে ভালোবাসে। সেই সময়ে তিনি এলেন চূড়ান্তভাবে নষ্ট হতে বসা চলচ্চিত্রের জগতে।
১৯৯৮ থেকে ২০১২, এই বছরগুলোতে তিনি নির্মাণ করেন আরও সাতটি চলচ্চিত্র। তাঁর উপন্যাসের মতো চলচ্চিত্রগুলোও বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর সাহিত্যের পাঠকদের মতো চলচ্চিত্রের এই দর্শকরাও বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে সাধারণত যাদের চিহ্নিত করা হয়, অন্তত ওই সময়কালে, তাঁর চলচ্চিত্র এই গোষ্ঠীর বাইরে বেরিয়ে এসে মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকদেরকে আবারও চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।
দর্শকদের এই গোষ্ঠীগত বিভাজন- টিভির দর্শক-চলচ্চিত্রের দর্শক, তথা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত দর্শকদের এই বিভাজন নিয়ে যে সংকট, সেটিকে বলা যেতে পারে বাংলা চলচ্চিত্রের পতনের অন্যতম কারণ, একইসাথে ফলাফলও। দর্শকদের কেন্দ্র করে বাংলা চলচ্চিত্রে একটা দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে- ভালো দর্শক নেই বলে ভালো চলচ্চিত্র হয় না, আবার ভালো চলচ্চিত্র হয় না বলে ভালো দর্শকরা সিনেমা হলে যায় না। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র অন্তত হুমায়ূন আহমেদ তৈরি করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু একটা শিল্পমাধ্যম বা একটা সাহিত্যমাধ্যমকে একা হাতে টেনে নেয়াটা রীতিমতো অসাধ্য সাধনের মতো একটা ব্যাপার। তার উপর চলচ্চিত্র আবার যুগপতভাবে শিল্পমাধ্যম এবং সাহিত্যমাধ্যম। কাজেই হুমায়ূন আহমেদও পারেননি। তবে তাঁর একাধিক চলচ্চিত্র অন্তত এটুকু দেখিয়েছে, ভালো কাহিনি ও ভালো নির্মাণ হলে, এখনো মধ্যবিত্ত বাঙালি ঢাকার চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী। এখনো ঢাকার মধ্যবিত্ত নিজেদের গল্প দেখতে চায়, বাস্তবতার জমিনে নির্মিত সাধারণ মানুষের অসাধারণ গল্পই এখনো তাদের টানে, অলীক-অবাস্তব কাহিনি নয়।
হয়তো আরো কয়েকজন সঙ্গী পেলে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এই দুষ্টচক্র থেকে বের করেও আনতে পারতেন। সেটা না পারলেও, অশ্লীলতার ভরা যৌবনের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি অন্তত প্রমাণ করে গেছেন যে, ঢাকার চলচ্চিত্র এখনো সম্ভাবনাময়, এদেশের মানুষ এখনো ভালো সিনেমার জন্য পিপাসার্ত। সেই ধারাতেই এখনো বছর বছর দু-চারটা ভালো সিনেমা বানানোর চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে থেকেই সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে আসছে মনপুরা, আয়নাবাজির মতো চলচ্চিত্রগুলো। সে সব সিনেমা মুক্তির পরে হলগুলোতে মধ্যবিত্তের ভীড় বয়স্ক চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আবারও পুরনো দিনের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
লেখক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার কারণে চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের কথা আমরা মনেই রাখতে পারি না। অথচ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এমনকি এটাও বলা যেতে পারে, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের সংগ্রামটা লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও ছিল অনেক কঠিন, দ্বন্দ্ববহুল।
ঢাকার চলচ্চিত্র ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মহারথীদেরই এক রকম ভুলে বসে আছে দর্শক। হুমায়ূনআহমেদের অবস্থাও তেমনই। প্রত্যাশা, ঢাকার চলচ্চিত্রের এই প্রবণতাটি বদলাবে। আমাদের চলচ্চিত্রের সকল নমস্য ব্যক্তিদের নিয়মিত শ্রদ্ধা জানানোর ভদ্রতাটুকু করবে আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্ট্রি। ততদিন পর্যন্ত পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ, আপনি আমাদের মতো দর্শকদের কাছ থেকেই বিনীত শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।