হুমায়ূন আহমেদ সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন অনেকবার। নাটকের চরিত্র ‘বাকের ভাই’কে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল দেশজুড়ে। সবশেষ আলোচনা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও লেখকের ব্যক্তিজীবন; যা এখনও অমীমাংসিত। তবে মৃত্যুর পর থেকে দাফন পর্যন্ত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে টানা শিরোনামের ঘটনাটি ছিল নজিরবিহীন।
একজন মানুষের মাটির নিচে চিরবাসের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে এমন টানাপোড়ন বিরল। স্বাভাবিক কারণেই তা টেনেছে সংবাদকর্মীদের। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা ভাবি, বেশিরভাগ মানুষ যেটা বিশ্বাস করে, যা দেখতে বা করতে চায়, তার বিপরীতে অবস্থান নিলে অজনপ্রিয় হব। নিন্দার পাত্র হব। পরে ভালো কাজ করলেও সমর্থন পাওয়া যাবে না সমাজের। এই ধারণা বা বিশ্বাস বারবার ভুল প্রমাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। বাকের’র ফাঁসির মধ্য দিয়ে তিনি দর্শকের সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। মেয়ের বয়সী অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করাও সেরকমই ঘটনা। কেউ কেউ বিষয়টিকে সামাজিক অপরাধ হিসেবেও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তখন হয়ত বোঝা যায়নি, এসব কারণে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা এতোটুকুও কমেনি। বরং নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে নায়কের আসনটি পোক্ত করে নিয়েছেন তিনি নিরবে।
তুমুল জনপ্রিয় মানুষটির ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া এবং তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ ছিল মানুষের। হয়ত অজান্তেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল হিমু-মিসির আলির স্রষ্টার পরিণতির দিকটি। গাণিতিক খেয়ালির কাছে যমদূতের পরাজয় প্রত্যাশা করছিলেন সবাই। আসে ১৯ জুলাই। ভালো-মন্দের উর্ধ্বে চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। এ খবরের পাশাপাশি তাঁর মহিমা তুলে ধরতে নিজেদের সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দেয় পত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, নিউইয়র্ক থেকে কবে আসবে মরদেহ, কোথায় হবে দাফন? গদ্য, নাটক, সিনেমায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষটির শেষ ঠিকানা জানাতে গিয়েই তৈরি হয় বিপত্তি। করুণ আবেগের সুরের সাথে মিশে যায় পুরনো অমীমাংসিত লড়াই। পাঠক-দর্শকও উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তথ্যের জন্য। পারদের মতোই বাড়তে থাকে সংবাদ মূল্য। লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্কে জড়ান অনেক ভক্ত-অনুরাগী। সব টেলিভিশন চ্যানেলেও বিভক্তির উর্ধ্বে ছিল, তা বলা কঠিন। সবকিছুর ফল হল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় শিরোনাম। ‘যখন-তখন’ লাইভ সম্প্রচার।
সোমবার কফিনে করে দেশে ফেরেন প্রিয় লেখক। সেদিন নতুন করে অনুভূত হয় তাঁকে হারানোর কষ্ট। আবারও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চ্যানেলগুলো। সাধারণ মানুষের হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আবেগের বহি:প্রকাশ ঘটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা বা জাতীয় ঈদগাহে জানাজায় মানব-স্রোতের ঘটনায়। এতো এতো মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাধ্য কোন টেলিভিশনের!
হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মানুষ আবেগ আপ্লুত হলেও সঙ্কটের কোন সুরাহা হচ্ছিল না। শুটিং স্পট বা বাগান বাড়ি নুহাশ পল্লীতে দাফনের সিদ্ধান্তে অনড় শাওন। আর প্রথম পক্ষের ছেলে-মেয়ে এমনকি লেখকের বৃদ্ধা মা, তা চাচ্ছিলেন না। নিজেরা সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠক পর্যন্ত হয় গভীর রাতে। পরে লেখকের ভাই আরেক তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানান, নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও শাওনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। তারা চান না, হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ পড়ে থাকুক বারডেমের হিমঘরে।
সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনার উপাদান হিসেবে সময় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রেও থাকে ‘আগ-পাছ’। আগে দৃশ্যমান হোক বা না-হোক, চাপা পড়া অনেক কিছুই তখন চলে আসে সামনে। সব দিক বিবেচনায় তাৎক্ষণিক যেটা সবচেয়ে ভালো মনে হয়, সেই সিদ্ধান্তটাই নেন বার্তা সম্পাদক। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে নিয়ে খবর প্রচার করতে হয়েছে সংবাদকর্মীদের। তাৎক্ষণিক শতভাগ বিভ্রান্তিহীন তথ্য পরিবেশনের চেষ্টা থাকলেই তা করা যাবে, এমন নয়। দাফনের ব্যাপারে সূত্র হিসেবে নির্ভর করতে হচ্ছিল পরিবারের সদস্যদের মুখের কথার ওপর। তাদের কথার সূত্র ধরেই তৈরি হয় বিভ্রান্তি এবং তা সময়ের সাথে বেড়েছে। দায়’র কিছুটা গিয়ে পড়েছে গণমাধ্যমের ওপরই। সব মিলে মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের যে কর্মযজ্ঞ, তা তাঁর প্রাপ্য ছিল। একই কারণে হয়ত, মৃত্যুর পাঁচ বছর পরও বইমেলায় তাঁর বই-ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়!