১.
ক)
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের প্রধান চরিত্রখানির বর্তমান চেহারাটি একখানি পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি হয়েছে।
জি, ভদ্রমহোদয় এবং দয়া, সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনমুক্ত সত্য।
চরিত্রটি ক্রিসমাসের পোস্টারবয়, গোলগাল হাসিখুশি চেহারার সাদা-দাড়ি আর লাল পোশাক পরা ক্লস, স্যান্টা ক্লস; নাম তো সুনাহি হোগা। আর হ্যা! পণ্যটি দ্য কোকা কোলা।
বিগত শতকের ’২০র দশক থেকেই কোক স্যান্টাকে নিয়ে বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছিলো। তখন অবশ্য স্যান্টার নির্দিষ্ট কোন চেহারা বা পোশাক ছিলোনা। আর এ সময় পর্যন্ত যাবতীয় বইপত্র বা অন্য মাধ্যমে স্যান্টা সাহেবকে চেহারা-সুরতের জন্য শিল্পী মহোদয়ের মুডের উপর নির্ভর করে থাকতে হোতো।
১৯৩১ সালে হ্যাডন স্যান্ডব্লম কোকের জন্য প্রথম বারের মতো আজকের লাল-সাদা চেহারার গোলগাল হাসিখুশি চরিত্রটি আঁকেন।
আর আমরা তখন থেকে হাসি-খুশি মনে কোক খেয়ে চলেছি।
খ)
বিবাহ উৎসব।
ছাদনা তলায় যাবেন আর ভ্যাট দেবেন না থুক্কু হিরের আংটি* গলাবেন না তা কি হয়? (* এটার সাথে সত্যি সত্যি ৫% ভ্যাাট আছে)। যায় যাবে যাক প্রাণ (আরএফএল নয়), হীরকের রাজাইতো ভগবান, তাই না! তো হিরে লাগবেই।
কিন্তু বিবাহের সাথে হিরের সম্পর্কটা কোথায়?
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকেই হিরার খনির সিন্ডিকেট ডি বিয়ার্সের ব্যবসা ধুঁকছিলো। বিক্রি-বাট্টা একদম ভালো চলছিলো না। আর ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) কারণে অবস্থাতো আরো খারাপ। উপায় না দেখে বিজ্ঞাপনী সংস্থা এন ডব্লু আয়ারে ধর্ণা দিলেন তারা।
তাদের ক্রিয়েটিভ মেরি ফ্রান্সেস গ্যারেটি এমন এক মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন, এখন পর্যন্ত নারীরা সে মন্ত্রে বশীভূত হয়ে পিড়িতে বসতে রাজি হয়ে যান। (আর বসার ব্যবস্থা হলে…)
মন্ত্রখানি হচ্ছে- ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফর এভার’।
আর কোথায় যাবে মাতুল ! চিরদিনই তুমি যে আমারের সাথে হিরা চিরদিনের সংযোগ হতে কি আর দেরি লাগে। একটা সাধারণ মনি-পাথর হয়ে যায় মহামূল্যবান চির আরাধ্য অমূল্য এক রতন।
জয় বাবা অ্যাডনাথ!
গ)
রমজান শুরু হয়েছে।
ইফতারে রুহ্ আফ্জা নেই! সম্ভব নাকি?
রোজদার কি বেরোজদার, রোজার সময় রুহ্ আফ্জা চাখতে পছন্দ করেন না, এমন লোক পাওয়া মুশকিল। সারা বিশ্বের মতো উপমহাদেশের মুসলমানদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার হচ্ছে রোজা। আর সারাদিনের রোজা শেষে ইফতারের অতি আবশ্যকীয়-কাঙ্খিত পানীয় হয়ে গেছে এই গোলাপ আর ফলের স্কোয়াশ, রুহ্ আফ্জা বা হৃদয় প্রশান্তকারী।
স্কোয়াশ তো আরো আছে, কিন্তু রুহ্ আফ্জাই কেন? ধর্মীয় এই আচারের সাথে এর যোগ কোথায়?
যে এলাকায় হারাম বুলেটের দোহাই দিয়ে ক্যু বা সিপাহী বিদ্রোহ বাঁধিয়ে দেওয়া যায়, যে দেশের ৯০% মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি (গরু, ছাগল, মহিষ জাতীয় হালাল পশু ছাড়া আর কোন পশু এদেশে সহজলভ্য? ) বলে সাবান বাজারে গোলমাল লাগানো যায়; সে অঞ্চলে প্রায় ৬০ কোটি মুসলমানের মার্কেটে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হালাল পানীয়’ বলার পরে আর কিছু লাগে?
সাথে উপরি পাওনা আরবি হরফে উর্দুতে লেখা প্যাকেজিং। এ উপমহাদেশে বজরঙ্গী ভাইজান চরিত্রটা একটি নিপাট বলিউডি গিমিক এবং অক্সিমোরন।
২.
ক)
রূপচাঁদা’র ‘ঘরে ফেরা’ অথবা গ্রামীন ফোনের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ ঈদকে (আমার ‘ঈদ’ আমি বলব, যেটা ইচ্ছে সেটাই বলব) মাথায় রেখে দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের বলা একটাই হৃদয় ছোঁয়া গল্প। দিওয়ালি উপলক্ষে ( আমরা যারা বাঙলা মিডিয়াম, যারা কোয়েলা রেস্টুরেন্টকে কয়লা পড়ি, তাদের কাছে দীপাবলী) তানিস্ক’র শুভম সিরিজের মন ভালো করা বিজ্ঞাপন। অথবা জে এন্ড বি’র সেই বিখ্যাত ‘…ইঙ্গেল …এল, …ইঙ্গেল …এল’ প্রিন্ট এ্যাড।
সব উৎসবে বিজ্ঞাপন আছে, উৎসবে সবকিছুর বিজ্ঞাপন আছে। কেন?
খ)
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন মার্কেট প্রায় আড়াই হাজার কোটি বলে ধরা হয়। যদিও অর্থমন্ত্রীর কাছে এটি কিছুই না তবুও সাধারণের কাছে এটি অসাধারণ অংকই বলা যায়।
এর মধ্যে টিভি বিজ্ঞাপনের পিছনে ব্যয় প্রায় হাজার দেড়েক কোটি টাকা বলে ধারণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে প্রতি ঘণ্টা অনুষ্ঠানের বিপরীতে ১২ থেকে ১৪ মিনিট বিজ্ঞাপন থাকে। মানে ৬০:১২-১৪ বলা যায়। বাংলাদেশে সাধারণ সময়ে বিজ্ঞাপন থাকে ঘন্টায় ১৮ থেকে ২২ মিনিট মানে ৬০:৩০।
মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে থোড়াই কেয়ার করে ঈদের সময়তো এটি ৬০:১২০তে গিয়েও দাঁড়ায়। কেন? কেন?
৩.
‘ইকনমিক্স অফ ক্রিসমাস’ বলে একটা টার্ম এখন দাড়িয়ে গেছে।
২০০৪ এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমেরিকাতে খুচরা কেনাকাটা ক্রিসমাসের সময় ৫৪% বেড়েছে। বইয়ের বিক্রি ১০০% আর দ্য গয়না-গাটিস ১৭০%।
পুঁজিবাদী আমেরিকানরা থ্যাংকস গিভিং-এ হলিডে ট্রিপ মেরেছিলেন ৪৬.৩ মিলিয়নটি। সাম্যবাদী চীনে চাইনিজ নিউ ইয়ার বা স্প্রিং ফেস্টিভল টাইমে ট্রিপ হয়েছে ২.৮ বিলিয়নটি। আমেরিকানদের রেস্টুরেন্টে বিল ছিলো ৫০.৯ বিলিয়ন আর চাইনিজদের ১০০ বিলিয়ন। টিভি ভিউয়ারশিপ আমেরিকানদের ছিলো ৩২ মিলিয়ন আর চাইনিজদের ৭০০ মিলিয়ন।
কিতনে বিজ্ঞাপন থা, আরে ও সাম্ভা…
৩ হাজারেরও বেশি অক্ষর নিয়ে যাদের বর্ণমালা তাদের ডিটেইল পরিসংখ্যান স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
একবার চীনের সব বিড়াল ধরে ধরে মেরে ফেলা শুরু হলো। কারণ হিসাবে জানা গেল বিড়ালরা চেয়ারম্যান মাওকে মাও বলতে পারে না, ম্যাও বলে।
এই গল্পের সাথে এই লেখার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। এমনিই বলা।
আমাদের এখানকার পরিসংখ্যান তেমন সহজ লভ্য নয়। আমাদের ঈদ, পুজা বা পহেলা বৈশাখের খরচ যে সাধারণ সময়ের চাইতে অনেক গুণ বেশি তাতো সাধারণ জ্ঞানেই বলা যায়।
৩.
প্রতিটি উৎসবেই মানুষের অনেক ধরনের পণ্য ও সার্ভিসের প্রয়োজন পড়ে।
তাকে নতুন পোষাক কিনতে হয়, বাইরে খেতে হয়, প্রচুর রান্নার সামগ্রী, ভ্রমনের অনুসঙ্গ, সাথে সাজ-সজ্জা-অলংকার আরো কতো ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সারা বছরের জন্য হলেও উৎসবের সময় চাহিদা চূড়ায় ওঠে।
কিছু পণ্য আবার শুধু উৎসবকে মাথায় রেখেই প্রস্তুত হয় মানে তাদের মূল ব্যবসাটা এই সময়ই। যেমন- আমাদের দেশে টুপি, আতর, সেমাই, পাঞ্জাবি, ভাঙা বাস-লঞ্চ ইত্যাদি।
পণ্যপ্রস্ততকারী, সার্ভিস প্রোভাইডারদের তাই এই উৎসব সিজনেই মুনাফার যুদ্ধে নেমে পড়তে হয়।
আর তার জন্য চাই বিজ্ঞাপন। মুনাফাকে নিশ্চিত করে বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন যেখানে মুনাফা সেখানে।
বিজ্ঞাপনের আসল কাজ সাধারণ মানুষকে জানানো তার কোন জিনিসটা নেই অথবা জানানো কোন জিনিসটা না থাকলে তার জীবনটাই বৃথা।
কড়ি স্বর্গ, কড়ি ধর্ম, কড়িহী পরমং তপঃ-এর যুগে বিজ্ঞাপন ছাড়া এমন বন্ধু আর কে আছে, তোমার মতো সিস্টার…
৪.
উৎসবের সাথে প্রতিটি মানুষের কতগুলো আবেগ ও অনুভূতি জড়িত।
স্মৃতিকাতরতা বা নস্ট্যালজিয়া, অন্যের প্রতি ভালোবাসা, উদারতা, রোমঞ্চপ্রিয়তা, ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্য, নিজের জমক দেখানো ইত্যাদির শেষে আনন্দ- অনুভূতিও এসময় আরো প্রকট হয়।
বিজ্ঞাপন ঠিক এই আবেগগুলোকে চিহ্নিত করে। তারপর একদম ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবনের মত ছবি আর কথার মধ্যে গুলে গিয়ে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলে। অতঃপর মাল খানি আপনাকে গছিয়ে দেয়। আপনি তা টেরও পান না। উদাহরন?
নস্ট্যালজিয়া- রূপচাঁদা তেলের বাড়ি ফেরা, অন্যের প্রতি ভালোবাসা- এ্যামাজনের হ্যাপি দিওয়ালি, উদারতা- রবি’র দুস্থদের পাঞ্জাবি উপহার, রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য কত ট্রাভেল প্যাকেজ অফার, ঠাঁটবাট দেখানোর জন্য জামাকাপড়, গাড়ির লোনতো আছেই।
সবার উপরে একজন আছেন। আনন্দ অনুভুতি। মানুষ যখন আনন্দে থাকে, তখন সে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে।
সুতরাং তাকে আরো আনন্দ দাও। তার আনন্দের সাথে মিশে যাও। তার উৎসবের আবেগ-অনুভূতিগলোকে জয় করে নাও।
তাহলেইতো ‘বস’ সাত মন ঘি খরচ করবেন, রাধার নাচের নিমিত্তে। রাধা ক’টি পয়সা পাবে, সাথে বাজনদারেরাও আর এটা-ওটা তরল-কঠিনের সাপ্লায়াররাতো আছেই। তারাও পাবে। এইতো ব্যবসা জনাব।
৫.
আপনার নিজের উপর যতই আস্থা থাকুক না কেন, বিজ্ঞাপনের কাছে আপনাকে হারতেই হবে।
বারবার প্রচার, মানুষের মুখে তুলে দেওয়া কথা (ওয়ার্ড অফ মাউথ), খেয়াল না করা প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট (যেমন- সংবাদের ভিতরে পণ্যের গুন বলে দেওয়া, আরো অনেক আছে), স্পন্সর ইত্যাদি আপনার উপর প্রভাব ফেলবেই।
আপনার অবচেতন মন আপনাকে নিজের কাছে ছোট করে তুলবে। বলবে অমুক পণ্যটি আপনার কাছে নেই, সমাজে আপনি অচল। আপনার সন্তান বলবে, বন্ধুদের কাছে তার প্রেস্টিজ থাকেনা। সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, বাবা-মা, সমাজ এবং নিজের চাপে পড়ে পণ্যটি আপনি কিনতে বাধ্য হবেন।
তবে বিজ্ঞাপন আপনাকে এই সুবিধাটাও সাথে দেবে, যে আপনার মনে হবে আপনি নিজ ইচ্ছাতেই তা কিনেছেন, কারো প্রভাবে নয়। ভানুর মতো বলবেন- ‘ভাবসো আমি তোমার ডরে পুরি যামু, আমি নিজের ইচ্ছায় পুরি যামু’।
৬.
জীবনটা এখন একটা ম্যাড ম্যাক্সের রেস। দ্যাট ডাজন্ট সেল ইজন্ট আ ক্রিয়েটিভ, হে মাতুল। সৃজন, নীতি-নৈতিকতা বালাই নেই।
শঙ্খ ঘোষেই না হয় শেষ হোক-
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।