রূপালি পর্দার হাতছানি

চামড়ার বেল্টের সিটিজেন ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে বারোটা পেরিয়েছে একটু আগে। হল থেকে বেরিয়ে খেলানো চুলের ছাঁটে অভ্যস্ততার আলতো হাত বোলায় তরুণ ছেলেটি। সকালে ঈদের নামাজটা পড়েই এক ছুটে সিনেমা হলে এসেছিল আজ। ম্যাটিনি শোতে হলিউড তো মিস করা যায় না। এরপর বিকেল সন্ধ্যায় উর্দু হিন্দি বাংলার বন্দোবস্ত বেশুমার! আজকের সারাদিনে দেখা সবগুলো সিন যেমন মাথায় গেথে আছে, তেমনি মাথায় আজ বাড়ি ফিরে বাবার হাতে কানমলা খাওয়ার রিস্কটাও নেই। পকেটে নাইট শো’র টিকেটের আধখানা অংশটা সতর্কভাবে চেক করে নেয় সে, টহল মিলিটারিকে ওটা না দেখাতে পারলে আবার চিত্তির! এক টাকা পঁচিশ পয়সার ফার্স্ট ক্লাস টিকেটটার আধখানা অংশের অস্তিত্ব নিশ্চিত হতেই সে আরামসে একটা ক্যাপস্টান ধরিয়ে রিকশা ডাক দেয়—’সিদ্ধেশ্বরী যাবেন’?

বুঝতেই পারছেন, এটা ঠিক এখনকার কথা নয়, বহু বহু বছর পেছনের গল্প। তখন গুলিস্তান সিনেমা হল ছিল, যা আজ আর নেই, স্রেফ গুলিস্তান নামটা দিব্যি টিকে গেছে। সে সময়ে সিনেমা হলে ছবি দেখা ছাড়া ঈদের ব্যাপারটা ভাবাই যেত না। এই তরুণ ফিল্ম বাফ আজও স্মরণ করেন ঈদের দিনে সিনেমা দেখার গল্প। তার প্রৌঢ় মুখেচোখে এখনও ঝলমল করে সেদিনের রূপালি পর্দার গ্ল্যামলাইট।

১৯৫৪ সালের গুলিস্তান সিনেমা হল

ভারত, পাকিস্তান তো আছেই, হলিউডের ছবিও তখন এই অঞ্চলে জমজমাট। আজকের সিনেপ্লেক্স ট্রেন্ডে অভ্যস্ত জেনারেশনের বদলে তখনকার সিনেমাপ্রেমীরা বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’, ‘ব্যালাড অব আ সোলজার’, ’গানস অব নাভারন’ দেখতেন। আর ‘বৈজু বাওরা’ কিংবা ‘মোগল-এ-আজম’ তো ছিলই। ঈদ এলে পুরোই জমজমাট। বাজারের পয়সা মেরেকেটে নয়, সালামিতেই জমে ক্ষীর! ঈদ এসেছে, সিনেমাহলে না গেলে কী হয় নাকি!

জোনাকী, আনন্দ কিংবা মধুমিতায় ঝুলবে হাউসফুলের কার্ড

এ তো গেল সে যুগের ব্যাচেলর মুভিবাফদের কথা। টরেন্টের জমানায় এহেন লিজেন্ডদের গল্প এখনো ভাবালু করে দেয় আমাদের। আর সে সময়ে, মানে ধরুন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নতুন নতুন বিয়ে হওয়াদের জন্য দারুণ বিষয় ছিল ঈদে সিনেমা দেখতে যাওয়াটা। যাদের মা-বাবা বা আত্মীয়-স্বজন আছেন সে সময়ের, তারা এই দারুণ গল্পগুলো শুনেছেন। না শুনে থাকলে এখনই ফাঁকতালে আবদার করুন সেই গল্প শোনার জন্য। দেখবেন, সে গল্পগুলো বলার সময়ে তাদের সলজ্জ আর হালকা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সেই পুরোনো দিনের রূপালি পর্দার পুরো শো-রিল দেখতে পাবেন। আহা, সেইদিন চিরদিন!

আজকের দিনেও ঈদের দিনে সিনেমা দেখার চলটা আছে বটে। স্রেফ সিনেপ্লেক্সে নয়, এ দেশের যে কয়টা হল এখনো বেঁচে আছে, সেগুলোও তো এই ঈদের সময়টার অপেক্ষায় থাকে। যৌথ ছবির চল শুরু হয়েছে নতুন কায়দায় বেশ কয়েক বছর হলো। সেগুলোর সঙ্গে পিওর দেশীয় ছবির বাজারটাও একটু হলেও চনমনে হয় ঈদের উপলক্ষে। কিছু কিছু হলে ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ সাইনবোর্ডটা তো এখনো টিকে আছে ঈদের দিনের জন্যই!

সিলেটের দিলশাদ, খুলনার সোসাইটির সামনে পড়বে লম্বা লাইন

সময় সুযোগ মিললে ঈদের ছুটিতে সিনেমা হলে যান প্রিয়জনের সঙ্গে। বন্ধুদের আড্ডা জমুক সিনেমা হলের মোড়ে। অনেকেই আছেন যারা আজও সিনেপ্লেক্স বাদে পিওর সিনেমা হলের অভিজ্ঞতা পাননি। এবারের ঈদে এই এক্সপিরিয়েন্সটা নিয়েই ফেলুন। সিনেমা হলে রূপালি পর্দায় ঈদ জমুক জমজমাট।

তবে শেষমেষ অনেকেরই সময় আর সুযোগের সমীকরণটা মেলানো হবে না। তাতে কী, বাড়িতে ল্যাপটপে কিংবা টেলিভিশনের পর্দাই বিকল্প করে নিন।

ঘর হোক বা প্রেক্ষাগৃহে, ঈদ ঝলমলে হোক রূপালি পর্দায়!