চল মন ঈদগাহে

ঈদের আগের রাতে ঘুমটা ঠিকমতো আসতেই চাইত না। পরের দিনটা নিয়ে কত রাজ্যের পরিকল্পনা মাথার মধ্যে খেলতে থাকত। আর যত রাজ্যের চিন্তা- জামা-কাপড় সব ঠিকঠাক আছে তো, নতুন জুতো জোড়া কোথায় রাখলাম যেন, নতুন টুপিটা… সব মিলিয়ে যেটা হতো, সকাল বেলা ঘুমটা একটু দেরি করেই ভাঙতো।
ঠিক ভাঙতো না, ভাঙানো হতো। বড়দের তো আর রাতভর পরিকল্পনার আর চিন্তার ঠেলাঠেলিতে সারা রাত জেগে কাটাতে হতো না। ভাগ্যিস! তাই তারা সকাল-সকাল উঠে, ঈদের আয়োজন করার ফাঁকেফাঁকে ছোটদের ঠেলেঠুলে ডেকে দিতে পারতেন। তাও উঠে দেখা যেত, হাতে আর বেশি সময় নেই। দৌড়াদৌড়ি করে গরম পানি নিয়ে হুড়োহুড়ি করে গোসল সারতে হতো। তারপর ঈদের জামা গায়ে দিয়ে ঈদগাহ পানে ছুট।

তাও উঠে দেখা যেত, হাতে বেশি সময় নেই। হুড়োহুড়ি করে গোসল সেরে, কোনো মতে ঈদের জামা গায়ে দিয়ে ঈদগাহ পানে ছুটতে হতো।

এখন অবশ্য আগের মতো হুড়োহুড়ি করতে হয় না। এখন প্রায় সবখানেই অনেকগুলো ঈদের জামাত হয়। যারা সকাল সকাল উঠতে পারে, তারা সকালের প্রথম জামাতটাই ধরতে পারে। যাদের একটু দেরি করাটাই অভ্যেস, তাদেরও কোনো সমস্যা নেই। তাদের জন্য আছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাত। তাও মিস হয়ে গেলে, একটু খোঁজখবর করলেই দেখা যায়, কাছে-পিঠে কোথাও আরো পরে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আগে কিন্তু এই সুবিধাটা ছিল না। ঈদের জামাত হতো একটাই। আর সবখানে প্রায় কাছাকাছি সময়েই হতো। বেশি মুশকিল হতো শীতকালের ঈদগুলোতে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে গোসল সারতে হতো। তারপর ঈদগাহে গিয়ে বসে বসে হাতে হাত ঘষে শীত তাড়ানোর চেষ্টা করতে হতো। একই সাথে মনোযোগ দিতে হতো ঈদের নামাজের অতিরিক্ত ৬ তাকবিরের প্রতিও।

সাধারণত একা একা কেউ ঈদগায় যেত না। রীতি ছিল দলবেঁধে যাওয়ার।

অবশ্য ঈদগায় যাওয়ার ব্যাপারটাও কম আনন্দের ছিল না। একা একা কেউই যেত না ঈদগাহে। রীতি ছিল দলবেঁধে যাওয়ার। সেটা হয় বাসার সবাই মিলে একসাথে একটা দল হয়ে, কিংবা পাড়ার বন্ধুরা মিলে দল পাকিয়ে। দুই তরিকাতেই দলের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে যেত। এক ভাগের সদস্যরা মোটামুটি ঠিক সময়েই রেডি হয়ে যেত। আরেক ভাগের রেডি হওয়া শেষ হতো একদম শেষ মূহুর্তে। তাই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চলত ঠেলাঠেলি।
ওদিকে মাইকে ইমাম সাহেব ক্রমাগত সবাইকে ঈদের জামাতের দাওয়াত দিতে থাকতেন। দলে দলে যোগ দিন। সেই সঙ্গে সবাইকে ঈদের তাকবিরও মনে করিয়ে দিতেন- আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর, ওয়া লিল্লাহিল হামদ। মাইকে হুজুর এই তাকবিরটা বলা শুরু না করা পর্যন্ত ঈদটা যেন ঠিক শুরু হতো না।

নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও হুজুর খানিক্ষণ কালক্ষেপণ করতেন।

এই করতে করতে ঈদের জামাতের জমায়েত একরকম জমে যেত। তবে তখনো বহু লোকের আসতে বাকি। তারা এসে পৌঁছত একদম শেষ মুহুর্তে। হুজুর নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও খানিক্ষণ কালক্ষেপণ করতেন। কাতার সোজা করার অজুহাত তো আছেই। তারপর সরল স্বীকারোক্তি করে মাইকে বলতে থাকতেন, যারা ঈদগাহর কাছাকাছি আছেন, চলে আসুন। এখনই ঈদের নামাজ শুরু হয়ে যাবে।
এই ঘোষণা শুনে আরো কিছু লোক পড়িমড়ি করে ছুটে আসত। তারপর জামাত শুরু হয়ে যেত। আর সালাম ফেরানো শেষ হলে দেখা যেত, কিছু লোক তখনো পড়িমড়ি করে ছুটে আসছে। কিংবা চোখেমুখে অসহায় চাহনি ফুটিয়ে হতাশার সাথে হাঁপাচ্ছে। মাত্র এসে পৌঁছল। তাদের কপালে আর ঈদের নামাজ জুটত না। ৬ তাকবির-ওয়ালা দুই রাকাতের এই ওয়াজিব নামাজের জন্য তাদের তখন পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হতো।