ঈদ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

‘আগামীকাল ঈদ’- মস্তিষ্কে দারুণ ঝাঁকি দেয়া তীব্র এ খুশির খবরটি এখন পেতে হয় চারকোণা স্ক্রিন থেকে। ফরওয়ার্ডেড লম্বা ঈদ এসএমএস, ফেসবুক পোস্ট কিংবা চাঁদ দেখা কমিটির বরাতে পাওয়া নিউজ স্ক্রল জানিয়ে দেয় রাত পোহালেই ঈদ। এছাড়া উপায় কী। বিশাল হাইরাইজে ঢাকা এ ঢাকার শহরে আকাশ তো দেখাই যায় না। কারো কারো সে সৌভাগ্য হলেও আরবান পলিউশনের দাপটে কালো মেঘের আড়াল থেকে কাস্তেসদৃশ বস্তুটির দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ক্ষীণ। গ্রাম-মফস্বল বা বিভাগীয় শহরগুলোতেও পৌঁছে গেছে বোকাবাক্স। এখনও কি চাঁদ দেখা ছোটোবেলার মতোই রোমাঞ্চকর? নাকি সকলেই বন্দি নানা সাইজের চারকোণা স্ক্রিনে? আশা করি, ঈদ এখনও নির্ভেজাল আনন্দেরই উপলক্ষ্য। স্ক্রিনে স্ক্রিনেও তাই আনন্দ বিলানোর নানান ফন্দিফিকির। জীবন, পৃথিবী চারকোণা স্ক্রিনেই আটকা (আয়রনি হলো, এ লেখাটাও তেমন একটা স্ক্রিনেই পড়ছেন)।

ইতিমধ্যে ওই চারকোণা স্ক্রিনগুলো জানান দিচ্ছে ঈদের ছুটি শুরু হয়েই গেলো। সারাবছর রুজি-রুটির ধান্দায় থাকা মানুষগুলোর জন্য ঈদ মানে আনন্দের চেয়ে, ক’টা দিনের রিফ্রেশ বাটন। আপনজনের সাথে ক’টা দিন কাটানো। এর মধ্যেও চতুর্ভুজ স্ক্রিনের মায়াটান পিছু ছাড়ে না। তাই ছুটি কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে একটু স্মার্টফোন গুঁতানো কিংবা টিভি স্ক্রিনে চ্যানেলে চ্যানেলে উৎসবের রং মাখা, বর্ণাঢ্য আয়োজন দেখা কিংবা চাঁদনী রাতে হাসনাহেনার গন্ধ (মাই ব্যাড! আজ পর্যন্ত বিষয়টা বুঝে উঠতে পারিনি) শোঁকা চলতে থাকে। কর্মজীবী পুরুষদের এ ঈদের বন্ধে অবশ্য কয়েকজনের উপর দিয়ে বেশ ধকল যায়। প্রথমত বিভিন্ন খাবারদাবার তৈরি আর পরিবেশনে এবং দিনমান বিভিন্ন ফুটফরমাশে নিয়োজিত মা-বোন-স্ত্রী-ভাবী সম্প্রদায়, তারপর ধরুন আপনার উদর মহাশয়, আর তারপরই আপনার টিভি রিমোট। অবশ্য আপনি বলতেই পারেন, যে হারে বিজ্ঞাপন চলতে থাকে, একটা নিদিষ্ট চ্যানেলে বেশিক্ষণ আটকে থাকা মুশকিল হি নেহি, মিশন ইমপসিবল হ্যায়। ওহ্ বিদেশি ভাষা চলেই এলো। কী করবো বলুন, আপনার মতো আমিও তো সারাবছর বলিউড-হলিউড দেখে-টেখে সবে দেশি চ্যানেলগুলোর ওপর নজর দিয়েছি। তবে নজর মাত্র পড়লেও, ওতে বিজ্ঞাপনই দেখছি কেবল। ঘটনা সত্য, সাক্ষী নির্দোষ।

তিন বছর আগে দেশের একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিজ্ঞাপনদাতাদের উৎসাহিত করার জন্য তাদের সাইটে কোরবানির ঈদে বিজ্ঞাপন দিলে গরু উপহার দেয়ার কনটেস্ট চালু করেছিলো। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যে বিজ্ঞাপনের মার্কেট নেক্সট, তা অনেক আগে থেকেই বুঝতে শুরু করেছেন অনেকে। তাই নামী প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল মিডিয়ামে দেদারসে টাকা ঢালছে। শহরে বাস করে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে করতে আরো অনেকের মতো আপনি-আমিও ভাবা শুরু করে দিয়েছি, ওটাই যেহেতু বুমিং মার্কেট, বিনিয়োগ ওতেই হবে। টেলিভিশন আজকাল ক’জন দেখে? এরপরও আপনি-আমি কিন্তু এবারের ঈদের পঞ্চম দিনে রিমোট টিপে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে ঠিকই বিরক্তি নিয়ে বলবো, “ধুস্, বিজ্ঞাপনের জ্বালায় একটা কিছু শান্তিমতো দেখার উপায় নেই”। ডিজিটাল মিডিয়ামই যদি হবে মার্কেটিংয়ের বর্তমান হ্যাপেনিং প্ল্যাটফর্ম, তাহলে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের আধিক্য এখনও এত কেনো? মার্কেট সাইজ বিবেচনায় নিলে সহজেই উত্তর পাওয়া যাবে। আপনার-আমার পরিচিত গণ্ডিতে সবার হাতেই ইন্টারনেট ঘুরছে। কিন্তু এখনও সারাদেশে রেগুলার ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা সাকুল্যে দেড় কোটি হবে না। প্রায় সতেরো কোটি জনসংখ্যার দেশে পরিমাণটা খুব বেশি নয়। মার্কেটিংয়ের জন্য ডিজিটালই পরবর্তী কার্যকরী মিডিয়াম, সন্দেহ নেই। তবে এই মুহূর্তে দেশের সবচে বেশি অডিয়েন্স টেলিভিশনেরই। আর লাইভ ক্রিকেট খেলার বাইরে টেলিভিশনের দর্শক সবচে’ বেশি পাবার সম্ভাবনা ঈদের লম্বা ছুটির সময়টাতে তাই মার্কেটিয়াররা তাদের পণ্যের প্রমোশনের জন্য ঈদের সময় টেলিভিশন বিজ্ঞাপনকেই টার্গেট করবেন সেটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন যে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে যৎকিঞ্চিত অনুষ্ঠান দেখাতে বাধ্য করছে। সেটার কী? হ্যাঁ, গুরুতর অভিযোগ। মানছি। কিন্তু একটি বাণিজ্যিক টেলিভিশন চ্যানেল চালাতে যে পরিমাণ খরচ প্রয়োজন তা বিবেচনায় নিলে চ্যানেলকে টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন প্রচার ছাড়া উপায় নেই। চ্যানেলের উপার্জনের একমাত্র বৈধ রাস্তা সেটাই। দর্শক কিন্তু প্রায় বিনামূল্যেই তার অনুষ্ঠান দেখছে। টাকা খরচ করে যেহেতু দেখতে হচ্ছে না, বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা একটু সহ্য করতেই হবে। চ্যানেলগুলোর জন্য ঈদের মৌসুমই ব্যবসার জন্য সবচে’ বড় সময়। সাধারণত পিক আওয়ারে ৮ মিনিট বিজ্ঞাপন আর ২২ মিনিট নাটক মিলিয়ে আধঘণ্টার নাটকের চাংক তৈরির নিয়ম। চ্যানেলভেদে কমবেশি হয়ে থাকে। ঈদের সময় ওসব নিয়মের কেউ ধার ধারে না। মিনিটের পর মিনিট বিজ্ঞাপনই চলতে থাকে। এর মাঝে অনুষ্ঠান শুরু হলো তো তার মধ্যেও নিচের স্ক্রলে পরবর্তী অনুষ্ঠানসূচি কিংবা নিউজ আপডেট চলতেই থাকে। একটু পর পর থাকে এল শেইপ (স্ক্রিন জুম আউট হয়ে স্ক্রিনের একপাশের হরাইজন্টাল আর ভার্টিকাল বার দখল করে প্রচারিত বিজ্ঞাপন), পপ-আপ (স্কিনের নিচের অংশে প্রচারিত বিজ্ঞাপন)-এর যন্ত্রণা। এত বিরক্তির শিকার হলে কিছু দেখার আর ধৈর্য কুলায় নাকি দর্শকের! চ্যানেলটিতে বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। বিরক্ত দর্শক রিমোট টিপে যায় হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথাও। সেটাতেও একই কাহিনী। বারকয়েক একই চক্রে ঘুরপাক খেয়ে শেষমেশ হয়তো বিদেশি চ্যানেলেই থিতু হয় দর্শক।

এক্ষেত্রে কথা থেকে যায়। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যই পটেনশিয়াল কাস্টমারকে সেটি দেখানো। কিন্তু দর্শক যদি তিতিবিরক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হওয়ামাত্রই চ্যানেল পাল্টে অন্য কোনোটায় চলে যান, তাহলে ওই বিজ্ঞাপন চালিয়ে লাভ কী? বোঝা গেল এতে দুই পক্ষেরই লোকসান। তখনই চলে এল স্বল্প বিজ্ঞাপন বিরতির অনুষ্ঠান প্রচারের আইডিয়া। ঘটনাটা ঘটে তিন বছর আগে। বেশ আওয়াজ তুলে জানানো হলো এবারের ঈদে কয়েকটি চ্যানেল গুটিকয় বিরতিহীন নাটক প্রচারিত হবে। প্রথম বছর গুটিকয় এরপর একটি টেলিভিশন চ্যানেল ঢাকঢোল পিটিয়ে বিরতিহীন ঈদ আয়োজন শুরু করলো। টিআরপি (যদিও প্রচণ্ডমাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ একটি সিস্টেম) জানালো, ওসব অনুষ্ঠানের দর্শক তুলনামূলক অনেক বেশি। তো প্রথম বছরে পাওয়া এ সাফল্যে টিভি অনুষ্ঠাননির্মাতা, প্রযোজক, বিজ্ঞাপনদাতা সবাই খুশি। দর্শক তো খুশিই। অনেকে আশায় বুক বাঁধলেন, এবার হয়তো বিজ্ঞাপনের প্রচারে আরো ভালো মিডিয়া প্ল্যানিং আসবে। ভালো ব্যবস্থাপনায় দুই পক্ষেরই স্বার্থ উদ্ধার হবে।

সে আশার গুড়ে বালি। তুলনামূলকভাবে নতুন এক টিভি চ্যানেল ঘটা করে ঘোষণা দিলো এবার তাদের অনুষ্ঠানগুলো হবে সব বিজ্ঞাপন ‘বিরক্তি’হীন। ব্যাপক স্টান্টবাজিতে ঈদের আগে অন্য চ্যানেলগুলোর মাথায় বাজ পড়লো যেনো। তবে অনেকের চোখে আশাবাদ। তারা বললেন, যে সব দর্শক দেশীয় টিভি অনুষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তারা আবার ফিরে আসবে। তাই কী? হয়তো এসেছে। কিন্তু বিরতিহীন অনুষ্ঠান প্রচার করে ইন্ডাস্ট্রির আদতে ক্ষতি হচ্ছে না তো? এ যুগে কাউকে তো আর জোর করে দর্শককে কিছু খাওয়ানোর জো নেই। বিজ্ঞাপন না চললে অনুষ্ঠানে দর্শক হয়তো বেশিই পাবেন, কিন্তু অনুষ্ঠান প্রচারবাবদ আপনার খরচের দায়ভার তখন অনুষ্ঠান নির্মাতার উপর পড়বে। অন্যান্য চ্যানেলের চেয়ে বেশি দামে প্রোগ্রামের এয়ারটাইম কিনতে হবে। এই খরচের ধাক্কা সামলাতে নির্মাতার বাজেটে টান পড়বে, হয়তো পছন্দমতো কাস্টিং করতে পারবেন না, কিংবা ধরুন কোয়ালিটিও ঠিক রাখা যাবে না। স্ক্রিপ্টে কাঁটাছেড়া তো হবেই। সবমিলে অনুষ্ঠান হতে পারে দায়সারা। অথবা ধরলাম, এই ভর্তুকির চাপ নির্মাতাদের উপর পড়বে না। সেক্ষেত্রে অবস্থা আরেকটু দুশ্চিন্তার। এর প্রভাব তখন পড়বে ঈদ বাদে বছরের বাকি সময়ের অনুষ্ঠান বেচাবিক্রিতে। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হতে পারে। নাটকের দর্শক হিসেবে আপনি হয়তো ঈদে বিজ্ঞাপনহীন নাটক দেখে শান্তি পেলেন। কিন্তু এই আপনিই যখন বছরের অন্য সময়ে লাইভ ক্রিকেটের দর্শক, দৃশ্যটা বদলে যেতে পারে। খেলা চলাকালে ওভারের বিরতিতে বিজ্ঞাপনের ঠ্যালা তো সামলাবেনই, এমনকি সেগুলোর দৌরাত্ম্যে ওভারের শেষ বলটা হতেই যখন বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবে, আবার মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপনে পরের ওভারে প্রথম কি দ্বিতীয় ডেলিভারিটাও খেয়ে দেবে, অভিযোগের তীরটা কার দিকে ছুঁড়বেন সেটা একটু বুঝেশুনেই ঠিক করবেন তখন।

তাহলে বিষয় দাঁড়াচ্ছে এই, মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন কিংবা একেবারেই বিজ্ঞাপন, দু’টোর কোনোটাই এ ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখকর নয়। আসলে, দুনিয়াজুড়েই উৎসবে কিংবা উপলক্ষ্যগুলোতে, যখন বেশি দর্শক পাবার সম্ভাবনা বেশি, সেটাকে টার্গেট করে বিজ্ঞাপন তৈরির ট্রেন্ড চালু রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রিসমাস, থ্যাংকস গিভিং ডে, ইস্টার সানডে, হ্যালোইনে উপলক্ষ্যকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন তৈরি হয়। ভারতেও দিওয়ালি উৎসব মানেই শুধু অফার বা সেল-নির্ভর বিজ্ঞাপন না, কাজ হয় কনজ্যুমার ইনসাইট বেইজড। বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনগুলোতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে উপলক্ষ্য মাথায় রেখে কে কার চে কতোটা ইফেকটিভ কমিউনিকেশন করতে পারলো তার উপর। ওসব বিজ্ঞাপন মানেই একরকম বিনোদন। মিডিয়া প্ল্যানিং আর বায়িংও হয় জোরদার। কেউ বলতেও পারবে না, অন্য সময়ের চেয়ে বেশি বেশি অ্যাড চলছে।

শেষ কথা হলো, বিজ্ঞাপন উপেক্ষা করা যাবে না। শুধু প্ল্যানিংটা করতে হবে বুঝমতো। বিজ্ঞাপন নির্মাতা আর এজেন্সিরও ভাবার দরকার আছে, ক্লায়েন্টদেরও। স্টেরিওটাইপড বিজ্ঞাপন না। বিজ্ঞাপন হোক ইনসাইটফুল, ক্রিয়েটিভ। তাতে করে বিজ্ঞাপন বিরতির সময়টাও উপভোগ্যই হবে দর্শকের জন্য।