নব্বই দশকের কথা। রমজান মাস শেষের পথে। কদিন পরেই ঈদ। কাজেই মনির সাহেবকে বাড়িতে আর্ট পেপার, রঙপেন্সিল, রঙিন কলম, সাইনপেন, আঠা ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতে হত। ছেলেমেয়েদের জন্য। ওরা ঈদ কার্ড বানাবে। এবং সেই কার্ডগুলো অন্যদের চেয়ে সুন্দরও হতে হবে। ইতিমধ্যেই ওদের এবারের কার্ডের ডিজাইন-থিম রেডি। রোজার শেষ দশদিনে নতুন জামা-জুতোর সাথে কার্ডের কারিকুরি নিয়ে চলছে মনির পরিবারের আরেক উৎসব।
এমনকি গত দশকেও রোজার ঈদে ঘরে ঘরে এই দৃশ্য ছিল বাস্তবতা। তখন ঈদ কার্ড ছাড়া রোযার ঈদের কথা ভাবাই যেত না। সব বাড়িতে হাতে হাতে তৈরি করা হতো ঈদ কার্ড। সে কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিত বাড়ির কিশোর ছেলেমেয়েরা। আর ছোটরা হত শ্রমিক। আর্ট পেপার কেটে, রং করে, এঁকে-হাতে লিখে বানানো হতো ঈদ কার্ডগুলো।
কার্ডের উপরে নকশা করে বাংলায় বা ইংরেজিতে লেখা হতো ঈদ মোবারক বা Eid Mubarak। ঈদের সেই শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে তাতে কখনো ছবি আঁকা হতো, কখনো ফুল-পাখি-লতাপাতায় লেখাটা মুড়ে দেয়া হতো। কচি মনের চিত্রকলা-প্রতিভার তুমুল স্বাক্ষর হয়ে উঠত কার্ডের প্রচ্ছদগুলো।
তবে সবচেয়ে সৃষ্টিশীল অংশ ছিল কার্ডের ভেতরের অংশটা। তাতে যেমন নকশা করা হতো কিংবা ছবি আঁকা হতো, সেই সঙ্গে লেখা হতো সুন্দর সুন্দর সব কথা। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাংলায় বা ইংরেজিতে দুটো অসাধারণ বাক্য, কিংবা চার চরণের পদ্য লেখাটাই ছিল দস্তুর। সেই লেখার সঙ্গে মিলিয়ে আবার নকশাও করতে হতো, বা আঁকতে হতো ছবি।
আর লেখার নিচের অংশটা ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কার্ডটা বানানোতে যারা অংশ নিয়েছে, লেখার নিচে তাদের নামগুলো মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করত। কার্ড বানানোর এই যে সংগ্রাম ও অধ্যবসায়, তার বিনিময়ে প্রধান প্রাপ্তিই ছিল এইটে। কখনো যদি ভুল করে কারো নাম বাদ পরে যেত, কিংবা বানান ভুল হয়ে যেত, কিংবা লিখতে গিয়ে কাটাকাটি হতো, তার ঈদটাই অর্ধেক মাটি হয়ে যেত।
হাতে বানানো এই ঈদ কার্ডগুলো হয়তো আহামরি সুন্দর হতো না, লেখাগুলো-আঁকাগুলো উচ্চ সাহিত্যগুণে ভাস্বর হতো না, কিন্তু সেই কার্ডগুলোতে ভালোবাসা থাকত। সহজ-সরল ভালোবাসা। প্রত্যেকটা কার্ডে থাকত ব্যক্তির নিজস্ব ছোঁয়া। আমি যে কার্ডটা কাউকে দিতাম, সেটা আমি নিজে তার জন্য বানাতাম। কেউ আমাকে যে কার্ডটা দিত, সেটা সে নিজে আমার জন্য বানাত।
পরে এ রীতিতে খানিকটা পরিবর্তন এলো। পাড়ায় পাড়ায় চালু হলো ঈদ কার্ডের দোকান। রমজান যত ঈদের দিকে এগোতে থাকে, মোড়ে মোড়ে বসতে থাকে অস্থায়ী ঈদ কার্ডের দোকান। হলুদ কাপড় দিয়ে ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান বানিয়ে, তাতে সারি সারি ঈদ কার্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর সবাই জমানো টাকা নিয়ে, কিংবা বাসায় ঘ্যানঘ্যান করে টাকা জোগাড় করে, দোকানে এসে দামদর করে ঈদ কার্ড কিনে নিয়ে যায়।
ব্যাপারটা আরো বাণিজ্যিক হয়ে উঠতে লাগল এ শতকের প্রথম দশকে। যেহেতু ঈদ কার্ডগুলো উপহার হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল, কাজেই গিফট শপগুলো আগ্রহী হয়ে উঠল এদেরকে পণ্য হিসেবে তৈরিতে। তারা গোলাপ-মার্কা তারা-মার্কা মসজিদ-মার্কা উট-মার্কা নানা ডিজাইনের ঈদ কার্ডে ছেয়ে গেল শুরু করল। ভেতরে বাণী চিরন্তনীর ইংরেজি ভার্সন থেকে উদ্ধৃতি। দেখতে সুশ্রী, সুন্দর মোড়কজাত এই কর্পোরেট কার্ডের তোড়ে হারিয়েই গেল হাতে বানানো কার্ডগুলো।
গিফট শপের এই কার্ডগুলোও অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হতে পারল না। কারণ দ্রুতই বাংলাদেশ প্রবেশ করল টেলিকম-যুগে। চিঠিপত্রের মতো ঈদ কার্ডও ঢুকে গেল মুঠোফোনে। গোলাপ-মার্কা তারা-মার্কা মসজিদ-মার্কা উট-মার্কা ডিজাইনগুলো বাদ পরে গেল, রইল কেবল বাণী চিরন্তনীর ইংরেজি ভার্সন থেকে উদ্ধৃতি।
সেই পালে হাওয়া দিতে টেলিকম কোম্পানিগুলোও ভুল করল না। দিতে লাগল বান্ডেল মেসেজের অফার। আর মানুষও বাটন টিপে টিপে খুদে বার্তায় ঈদের শুভেচ্ছার বিলোতে লাগল। এই মেসেজ পাঠানোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল আরো কিছু সাইড-বাণিজ্য। মোবাইলে কতগুলো নাম্বার চাপলে চলে আসে হাজার হাজার ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা। সেখান থেকে পছন্দ করে নেওয়ার সুযোগ চলে এল আপনার হাতে।
ইদানিং আবার এই মেসেজিংও খানিকটা বাজার হারিয়েছে। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পড়ুন ফেসবুক)। এখানে আবার একটা ছবি আপলোড করে দিলেই শুভেচ্ছা জানানোর ঝামেলা শেষ। আরো ভালো করে জানাতে চাইলে, সবাইকে ট্যাগ করে দিলেই হলো। ছবিটা জোগাড় করাও একদম সোজা। গুগল মামাকে বললেই সে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর ছবি জোগাড় করে দেন।
কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই (বা ফেসবুক) নয়, গুগল মামার জোগাড় করে দেয়া ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো যায় আন্তর্জালিক পত্রব্যবস্থা তথা মেইলের মাধ্যমেও। এ দুটোই আবার করা যায় একদম মুফতে। পরিশ্রমও তেমন নেই, কী-বোর্ডে-মাউসে একটু সময় ব্যয় করলেই চলে।
এবং যেহেতু সময় নিজেই সময়ের সাথে তাল মেলানোর একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে দেয়, তাই গুগল মামার জোগাড় করে দেয়া ঈদের শুভেচ্ছা জানানো একটা ছবি থাকল পাঠকদের জন্যও। ঈদ মোবারক।