গানটার বাজার কথা ছিল চায়ের দোকানে, চাঁদ রাতে। কথা ছিল ইউটিউবে ভাইরাল হওয়ার। অনুষঙ্গও ছিল পর্যাপ্ত। দেদারসে খরচ হয়েছিল কস্টিউমে-মেকআপে। আজকের দিনের সঙ্গে সঙ্গত মিলিয়ে এভাবেও বলা যায় গানটার হওয়ার কথা ছিল ‘আইটেম’!
যদিও হচ্ছে না সেসব কিছুই। হয়েছে নিউজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা আর একটা মামলা।
বাণিজ্যিক ছবির দরকারি এক মশলা হিসেবে গানের ‘আইটেম’ হয়ে ওঠার বিষয়টা খুব নতুন ঘটনা নয়। ব্যাপারটা আগে থেকেই ছিল। সময়ে সময়ে ফর্মে বদল এসেছে আর কি। এককালের আইটেম গান নতুন দিনে আরও নতুন আইটেমে বানানোর হিড়িক লেগেছে বলিউডে। জিনাত আমানের ’লায়লা’ এ বছর সানি লিওনের মোড়কে পুনর্জন্ম নিয়েছে শাহরুখ খানের ‘রইস’ ছবিতে। এমন উদাহরণ এখন এন্তার। এখনকার দিনে ’আইটেম’ গান ছাড়া ছবির কথা চিন্তাই করা যায় না। বলিউডে যেটা ‘ইন’, ঢালিউডে যে সেটা অবশ্য মান্য গ্রামার; সে তো আর বলতে হয় না। ঢাকাই ছবিতেও তাই আইটেম গান এখন বাধ্যতামূলক।
সিনেমার আইটেম গানের বিষয়ে অসচেতন, সচেতন এবং অচেতন—সবারই কিছু না কিছু বক্তব্য রয়েছে। এমন হয়েছে, তেমন হয়েছে, অমুককে নকল করতে চেয়েছে, আরে গানের কোরিওগ্রাফিটা তো ওমুক গানের কপি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নিয়ে দিব্যি না চললেও ‘আইটেম’ গান বিষয়টা মোটামুটি চলছিল বলা যায়। রঙ্গ ভরা বঙ্গ দেশে বড়সড় গোল বেঁধেছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার মুক্তির অপেক্ষায় থাকা বস-২’র আইটেম গান, ‘আল্লাহ মেহেরবান’ নিয়ে। মামলা-মোকদ্দমার হদিস হামেহাল পাঠক জেনেছেন আগেই। গানটি ইউটিউব থেকে সরিয়েও নিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি থুড়ি দুই প্রতিষ্ঠানই। এটি আবার যৌথ প্রযোজনার সিনেমা কিনা!
সাধারণ থেকে অসাধারণ—তাবৎ দর্শকেরই এ গান নিয়ে বেজায় ক্ষোভ আর রাগ উঠেছে, তা মোটাদাগে বলাই যায়। সাদা চোখে গানের লিরিক আর নুসরাত ফারিয়ার কস্টিউমই সে বিরোধিতার মূল পয়েন্ট, এও সত্য। সে সব আলাপও এতক্ষণে অপ্রাসঙ্গিক। যদিও এই সেন্টিমেন্টাল পয়েন্ট দুটো বাদেও একটু মনোযোগ দিয়ে গানটি দেখলেই (নিজ দায়িত্বে) বুঝবেন, সামথিং ওয়েন্ট টেরিবলি রং উইথ দিস ‘আইটেম’! সে কারণেই বলা যায় ‘ছিল বেড়াল, হয়ে গেল একটা রুমাল’! মানে যাতে হবে সিনেমার প্রোমোশন সেটিই কিনা হয়ে গেল বুমেরাং!
১. পুরো গানে নুসরাত ফারিয়া রহস্যজনকভাবে ভাবলেশহীন! তার পেছনের সহশিল্পীরা অবশ্য কেউ হাসছেন, কেউ চুপচাপ, কেউ খুশিখুশি। হলোটা কি?
২. গানের শুরুর দিকটায় জিৎ সম্ভবত কাউকে খুঁজছেন। খুঁজতে এসে দেখছেন এখানে দিব্যি নাচগান চলছে। তিনি আসলে নাচ দেখে বিস্মিত, না কাউকে খোঁজার জন্য চিন্তিত- তা বুঝতে শার্লককে বরাত দিতে হয়।
৩. গানের কথা আর নাচের ঢপের সঙ্গত মেলানো যেন উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু মেলানোর চেয়েও কঠিন!
৪. জিতের ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ অভিব্যক্তি হুশ করে পাল্টে গেল, ক্যাজুয়াল পোশাকও বদলে গেল বলা কওয়া ছাড়া। তিনিও ’কারণ’ ছাড়াই নুসরাত ফারিয়ার সঙ্গে পাল্লা লাগানো অনুভূতিশূণ্য মুখভঙ্গি নিয়ে নাচতে শুরু করলেন! এদিকে নুসরাত ফারিয়ার পোশাক ফ্রেম বাই ফ্রেম বদলেই চলছে! প্রচুর কস্টিউম ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহর মেহেরবানিতে।
৫. নাচের ভঙ্গি, কস্টিউম আর আয়োজনে কত দেশ থেকে কত রকমের ফটোকপি হয়েছে—তার বিস্তারিত আলাপে না যাই। নিয়মিত দর্শক সবই আঙুল গুণে বলে দিতে পারবেন!
১৯৯৭ সালে একটি আইটেম গান নিয়ে বেজায় বিপদে পড়েছিলেন গোবিন্দ, শিল্পা শেঠি, অলকা ইয়াগনিক আর উদিত নারায়ণ। ‘ছোটে সরকার’ সিনেমার এক চুম্মা তু মুঝকো উধার দে দে, বদলে মে ইউপি বিহার লে লে গানটির জন্য তাদের গ্রেফতার হওয়ারও কথা ছিল। আদালতে বারবার ডাক পড়লেও তারা এড়িয়ে গিয়ে বেঁচেছেন। এখন বিষয়টি কালের গর্ভে প্রায় হারিয়ে গেলেও সে সময়ে ভালোই ঝক্কি পোহাতে হয়েছে তাঁদের, ইনফ্যাক্ট এখনো হয় কালেভদ্রে। এই তো গেল বছরের জুলাই মাসে তাঁদের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টও ইস্যু করা হয়েছিল!
সেই সাতানব্বই সালেই কোরিওগ্রাফার সরোজ খান আর প্রযোজক বনি কাপুর বিপদে পড়েছিলেন তাদের সিনেমা ‘জুদাই’ নিয়ে। যে হট্টরোলে জড়িয়েছিলেন উর্মিলা মার্তন্ডকর আর অনিল কাপুরও। হা মুঝে পেয়ার হুয়া..পেয়ার হুয়া আল্লা মিয়া-এই গানের কোরিওগ্রাফি নিয়ে। যদিও মূল সিনেমার রিলিজের সময় গানটা পুরোই নতুন শ্যুট করে ফের জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। টাইটেল ট্র্যাক ছিল কিনা! যদিও প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের ২০০৪ সালের সিনেমা মীনাক্ষীর সে সৌভাগ্য হয়নি। এবারে প্রশ্ন উঠেছিল নূর-উন-আলা-নূর গানটি নিয়ে। সুফি এই গানটির মধ্যে শুধু একটি শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় গানটিই বাদ দিয়ে দেন ক্ষুব্ধ পরিচালক মকবুল ফিদা হুসেন।
সুতরাং আল্লাহ মেহেরবান গান/আইটেমটির থুক্কু সিনেমাটির ভবিষ্যতই আপতত অনিশ্চিত, পরবর্তীতে যার চুড়ান্ত বিচারের ভার দর্শকের হাতে। সত্যি বলতে, এ গান নিয়ে বিতর্ক না করে গানটি আসলে বিতর্কের যোগ্য কি না, সে নিয়েই একটা বড় বাহাস হতে পারে।
এক ক্ষ্যাপাটে দর্শকের কথা বলি। গেল বছরে সুপারহিট আইটেম গান ‘কালা চশমা’র মূল ছবি ‘বার বার দেখো’ দেখে বেজায় চটে গিয়েছিলেন তিনি। হল থেকে বেরিয়ে প্রচুর গালিগালাজ করে বলেছিলেন, “এক নম্বরের ফালতু ছবি। ওই ‘কালা চশমা’ গানটাই তো শেষে দিয়ে রেখেছে; শুরুতে থাকলে ওটা দেখেই বেরিয়ে যেতাম।” এতে বোঝা যায়, ছবি মন্দ লাগলেও ’আইটেম’ তার বেজায় মনে ধরেছিল!
‘আল্লাহ মেহেরবান’ গানটির ভাগ্য কোনদিকে যাবে, সেটা সময় বলে দেবে। সাধারণ দর্শক হিসেবে আফসোস করাই যায়—‘কী হইতে কি হইয়া গেল বাবু’!
ছবি ইউটিউব থেকে