করোনার কাছে হেরে যাওয়া এক বাবার গল্প

করোনা ভাইরাসের তান্ডবে বর্তমান বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির জনপথ মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহরের রাস্তায় এখন মৃত্যুর আতঙ্ক। মৃত্যুর মিছিলে রয়েছেন হাজারো বাংলাদেশী, তাদেরই একজন মোহাম্মদ জাফর।

সিএনএন-এর প্রকাশিত এক রিপোর্টের বরাতে জানা যায়, দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৯/১১ জঙ্গী হামলায় মৃতের সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছে। যা হয়তো দু’মাস আগেও কেউ ভাবতে পারেনি।

আর এই মৃতের মিছিলে বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকের সংখ্যাও কম নয়। এমনই একজন মোহাম্মদ জাফর(৫৬)। তিনি একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। নিজে কঠোর পরিশ্রম করে নিশ্চিত করেছেন সন্তানদের জন্য উচ্চ শিক্ষা এবং তাদের সুন্দর ভবিষ্যত।

মোহাম্মদ জাফর ১ এপ্রিল কোভিড ১৯-এর সংক্রমণে মারা যান। ১৯৯১ সালে দেশ থেকে জীবিকার তাগিদে যুক্তরাজ্যে পারি দেন তিনি। শুরুতে মেকডোনাল্ড সহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। এরপর তিনি ইয়েলো ক্যাব ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করেন। দেশে ফিরে বিয়ে করেন মাহমুদা খাতুনকে এবং তাকেও নিয়ে যানে নিজের সঙ্গে।

কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানদের সুন্দর একটি জীবন এবং সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন পাশাপাশি দেশে নিজের পরিবারকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু সন্তানদের সাফল্য দেখার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি তার। করোনার সংক্রমণে না ফেরার দেশে ফিরে গেছেন মোহাম্মদ জাফর। ব্রঙ্কসের গান হিল রোডের পাশে ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে তিন এতিম সন্তানকে ফেলে চলে গেছেন জাফর।

হলুদ-ক্যাব ড্রাইভার জাফর, দিনের প্রথম ট্রিপটি শুরু করতেন সেকেন্ড গ্রেড পড়ুয়া মেয়ে সাবিহাকে নিউইয়র্কের অন্যতম শীর্ষ ট্রিনিটি স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর সারাদিনই তিনি ক্যাব চালিয়ে স্কুল ছুটির সময় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যেতেন। জাফরের ছেলে মাহতাব সিহাব (১৯), পড়াশোনা করছেন বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি ও ইতিহাস দুই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা তার। ছোট মেয়ে সাবিহাও ভাইকে অনুসরণ করে হাঁটছে।

সিএনএন-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকায় আসা প্রায় সব প্রবাসীর জীবনের গল্পটা বেশ কঠিন এবং কষ্টের। প্রত্যের গল্প হয়তো আলাদা, কিন্তু বেদনার অংশটুকু সবার প্রায় একই রকম। তারা এই দেশে আসেন ভাগ্যের উন্নয়নে। হাড়ভাঙা খাটুনি করে সন্তানদের মানুষ করতে চান এবং পরিবারের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চান।

সংবাদমাধ্যমটির সঙ্গে এক কথোপকথনে জাফরের ছেলে মাহাতাব শিহাব বলেন, “বাবা সারা জীবন কঠোন পরিশ্রম করেছেন, এবং দিয়েছেনও অনেক। নিজের জন্য তিনি আলাদা করে ভাবেননি। তিনি কখনওই আহামরী কোনো চাকরি করেননি। ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করেছেন, কখনো ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর তিনি ক্যাব ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি সবসময় চেয়েছেন আমরা যেনো উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারি।”

শিহাব আরও বলেন, “বাবা সব সময় চেয়েছেন, আমরা যেনো বুঝি আমরা আমেরিকাতে থাকার কারণে বাংলাদেশের অনেকের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছি। তাই যতটুকু সুবিধা পাই তার যেন পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারি।”
শুরুতে জাফরের সন্তানেরা পড়াশোনা শুরু করে ব্রঙ্কসের পিএস ৯৫-এ । পরে তিনি জানতে পারেন নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াশোনার জন্য প্রিপ ফর প্রিপ নামের একটি সংগঠন সাহায্য করে থাবে। সন্তানের জন্য ওই সংগঠন থেকে সহায়তা নেন তিনি।

মাহতাব সিহাব সেভেন গ্রেডে ভর্তি হলেন ট্রিনিটি স্কুলে। তার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছিলেন উইল ক্র্যামার। দুজনই ডিবেট ক্লাবে একসঙ্গে ছিলেন।

২০১৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সিহাবের মা। ওই বছরই হার্ভাডে চান্স পান সিহাব। দুঃসময়ে কিছুটা আনন্দের আভাস নিয়ে আসে এই সাফল্য।

গত মার্চ মাসের শুরুতে করোনাভাইরাসের কারণে হার্ভার্ডে ছুটি ঘোষণা করা হয়। মাহতাব সিহাব বাড়ি ফিরেন। তার বাবা জাফর সেলফ কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ওই সময়। একদিন তিনি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েছিলেন ক্যাব চালানোর চাকরিটা আছে কিনা তা জানতে। এর কয়েক দিন পরই তার হালকা জ্বর আসে, শুরু হয় তীব্র শ্বাসকষ্ট।

সন্তানেরা তাকে নগরীর মন্টেফিয়োর মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান, সেখানে তাকে এক সপ্তাহ ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। শুরুতে অবস্থার উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত সন্তানদের কাছে ফিরতে পারেননি জাফর। নিউইয়র্কে করোনা সংক্রমণে প্রাণ হারানো শুরুর দিকের একজন মোহাম্মদ জাফর।

এবার নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে সিহাব আর সাহিবাকে। তাদের পরাশুনার খরচ আর অন্যান্য খরচ কিভাবে মিটবে তা ভেবে অথৈ জলে পরে তারা। এই সময় এগিয়ে এসেছে তাদের বন্ধুমহল। ছোটবেলার বন্ধু উইল ক্র্যামার তাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে গোফান্ডমি ক্যাম্পেইন শুরু করে।

এ বিষয়ে মাহতাব সিহাব বলেন, নিজ দেশসহ প্রায় সব কমিউনিটির মানুষ সাহায্য করছেন এই তহবিলে। বিশেষ করে এগিয়ে এসেছে প্রিপ ফর প্রিপ, ট্রনিটি স্কুল ও হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীরা।

তারা সত্যিই ভেবেছেন যে, আমরা চরম অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে পড়ে গেছি। ইতিমধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের তহবিল সংগ্রহ হয়েছে। করোনার এই সময়ও মানুষ মানুষের কত কাছে আসতে পারে, এটাই তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সিহাবের পিতা তার সন্তানদের যে উদ্দেশ্যে বড় করছিলেন সেই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তার সন্তানরা পিতার স্বপ্ন পূরণেই এগিয়ে যাবে, এমনটাই জানান সিহাব।