ঝাঁসির রানির খোঁজ- সিনেমায় নয়, বইয়ে

‘মণিকর্ণিকা’ আসছে, বড় পর্দায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ রুখতে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান সংগ্রামীকে নিয়ে আস্ত একখানা বায়োপিক। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইকে কেন্দ্র করে প্রথম বায়োপিক, যেখানে খোলা তরবারি হাতে রক্তাক্ত শরীরে রানির মাধ্যমে দর্শক দেখবে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝা চকচকে দৃশ্যায়ণ। ২ অক্টোবর, মঙ্গলবার ‘মণিকর্ণিকা’-র টিজারের দেখা মিলেছে।

আলোচনা-সমালোচনা এবং নানা ধরণের বিতর্কের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৫ জানুয়ারি বড় পর্দায় পৌঁছাবে কি কঙ্গনা রনৌতের মণিকর্ণিকা? হয়তো পৌঁছাবে, হয়তো না। মাঝপথে অনুভূতির দোহাইও তো থামিয়ে দিতে পারে কত কিছু! কিন্তু এত আলোচনা যে সিনেমাকে ঘিরে তা কি আর দু’দশটা বলিউডি বায়োপিকের থেকে খুব বেশি আলাদা হবে? ঝাঁসির রানি হিসেবে টিজারে অবশ্য কঙ্গনা রনৌতের রাগী, হিংস্র চেহারার দেখা মিলেছে দর্শকের। যদিও গোটা সিনেমায় যে ঐতিহাসিক সত্যাসত্যের খুব একটা ধার যে ধারেননি পরিচালক রাধাকৃষ্ণ জাগারলামুডি সেটাও মোটামুটি নিশ্চিত করেছে ওই একই টিজার।

আজকের জাতীয়তাবাদী জলুসে কম্পমান ভারতবাসীকে আরও মাতিয়ে তুলতে বলিউডে এমুহূর্তে বায়োপিকের বিকল্প নেই। গেল কয়েক বছরে বাজিরাও মাস্তানি, পদ্মাবাত এবং গোল্ডের মতো সিনেমায় সে ফর্মুলা অসম্ভব সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু যদি কেউ সত্যি সত্যি জানতে চান ঝাঁসির রানির সম্পর্কে? তখন? কে বলতে পারবেন মণিকর্ণিকার গল্প? কেতন মেহতা? যিনি ‘মঙ্গল পান্ডে’ বানিয়েছিলেন! নাকি কে. বিজয়েন্দ্র কুমার যিনি ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের অন্যতম ভিজুয়াল নমুনা ‘বাহুবলী’-এর গল্প লিখেছেন? নাকি অন্য কেউ?

মহাশ্বেতার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ

সেই ১৯৫৬ সালে, বাংলা সাহিত্যের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের অন্যতম, মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন রানি লক্ষ্মীবাইকে নিয়ে। আস্ত একটা বই। তাঁর প্রথম বই। ‘ঝাঁসীর রাণী’। নিজের বইয়ে কি বলতে চেয়েছিলেন মহাশ্বেতা? কেন ঝাঁসির রানির কথাই বলতে চেয়েছিলেন?

নিজের বইয়ে মহাশ্বেতা বলেছিলেন এমন এক সময়ের কথা যখন ভারত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে। ব্যরাকপুরের এক সেনা ছা্উনিতে এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় কিসের চর্বি মাখানো- এই বিতর্ক থেকে শুরু হওয়া সেই আজাদীর লড়াইয়ে সিপাহিদের অংশ নেওয়ার ছিল নিজস্ব আরও নানা কারণ। একাডেমিক ইতিহাস অবশ্য আজও সেই মহাবিপ্লবকে নাকচ করতে চায় শুধু ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলেই।
সিপাহি বিদ্রোহের ততোদিনে পার হয়ে গেছে প্রায় শত বছর। লড়াই করে, রক্ত ঝরিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আনার স্বপ্ন দেখা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজও ততদিনে ইতিহাস। উপন্যাস থেকে একাডেমিক পরীক্ষায় পাশের নোটবই, সবই। কিন্তু লক্ষ্মীবাই? তাঁকে নিয়ে তখনও যে লেখা হয়নি তেমন কিছু্ই!

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক-অ্যাকটিভিস্ট মহাশ্বেতা দেবী’

মহাশ্বেতা নিজে প্রাথমিক তথ্যের রসদ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একটি মারাঠি ভাষায় লেখা বইকে। যার লেখক ছিলেন ডি ভি পারসনীশ। বইয়ের নাম ‘ঝাঁসীচ্যা মহারানী লক্ষ্মী বাইসাহেবা য়াঞ্চে চরিত্র’। মারাঠি থেকে বাংলায় অনুবাদে তিনি সহায়তা নেন ডক্টর প্রতুল গুপ্তের। সাথে নিয়মিত যেতেন কলকাতার ভবানীপুরের মহারাষ্ট্র নিবাসে। মাতৃভাষা মারাঠি, এমন নানা পেশার মানুষের সাহায্য নিয়েই সাধ্যমত আক্ষরিক অনুবাদ সারেন।

গুগল-উইকিপিডিয়ার জনকদেরও জন্মের আগে এইভাবে এক সূত্র থেকে আরেক সূত্রের মারফত সত্যের খোঁজ নিতে শুরু করেন মহাশ্বেতা। রানি লক্ষ্মীবাই যে রাজা গঙ্গাধর রাও-এর প্রথম পত্নী ছিলেন না, বিবাহের পর ১৮৫১ সালে ঝাঁসির রানির যে একটি পুত্রও হয়েছিল সেই সব ইতিহাসের হদিস মহাশ্বেতা পেয়ে যান শুরুতেই। লক্ষ্মীবাইয়ের নিজের সন্তান তিন মাসের বেশি বাঁচেনি বলে গঙ্গাধর রাও ১৮৫৩ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় আনন্দ নামের এক আত্মীয়-পুত্রকে দত্তক নেন। সেসব তথ্যও মারঠি প্রাথমিক রসদের ভিত্তিতে নিশ্চিত হন মহাশ্বেতা। এমনকি দত্তক গ্রহণের অনুষ্ঠানে বুন্দেলখণ্ডের ইংরেজদের সহকারী রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেজর এলিসও উপস্থিত ছিলেন সে তথ্যও পেয়েছেন তিনি।

গঙ্গাধর রাও বা লক্ষ্মীবাই, দুজনের কেউই ভাবতে পারেননি, গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ইংরেজ সরকার এই দত্তক গ্রহণের বিরোধিতা করবে। কিন্তু তাঁদের ভুল হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ঝাঁসি জোর করে অধিগ্রহণ করে। যার বিরোধিতায় ১৮৫৭ সালে অস্ত্র হাতে তুলে নেন রানি লক্ষ্মীবাই, যুদ্ধে নিহত হন। ঝাঁসির রানির সেই লড়াই উদ্বুদ্ধ করে প্রায় শত বর্ষ পরে আজাদ হিন্দ ফৌজকে। সুভাষ চন্দ্র বসু INA’র নারী ফৌজের নাম রাখেন ‘রা‌নি ঝাঁসি স্কোয়াড’।

INA’র রানি ঝাঁসি স্কোয়াডের সদস্যদের প্রশিক্ষণ

একটা ছোট্ট ক্যামেরা যোগাড় করে একমাত্র পুত্র নবারুণকে বাড়িতে রেখে, স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের উৎসাহে ঝাঁসির রানির খোঁজে অভিযানে নামেন মহাশ্বেতা। তাঁর বড় মামা শচীন চৌধুরীও উৎসাহ জুগিয়েছিলেন রানির জীবনচরিত লেখায়।

ঝাঁসীর রাণী লেখার সময় নবারূণ ছিলেন একদমই ছোট

কলকাতা থেকে তখন ঝাঁসির সরাসরি ট্রেন ছিল না। উঠলেন সেনাবাহিনীর এক বাঙালি অফিসারের বাড়িতে। ছোট শহর ঝাঁসি তন্নতন্ন করে দেখেন রানির কেল্লা অবহেলিত অবস্থায়, শিবমন্দির-ফাঁসির মঞ্চও তথৈবচ। রানির নিত্য পূজার স্থান মহালক্ষ্মী মন্দিরও প্রায় ধ্বংসস্তুপ। স্বাধীন ভারতের ঝাঁসিতেই রানির একটি মূর্তি ছাড়া অন্য কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই।

ঝাঁসির রানি

কিন্তু রানিকে শেষ অবধি খুঁজে পেলেন মহাশ্বেতা। বৃদ্ধ টাঙাওয়ালা, কাঠকুটো জ্বালিয়ে-বসা কৃষক পরিবারের মেয়েদের মাঝে। তারা মহাশ্বেতাকে বলেছিল, ‘রানি মরগেই ন হউনি, আভি তো জিন্দা হোউ।’ সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন মহাশ্বেতা নিজেই, অনেক বছর পরে। এভাবে- ‘রানিকে লুকিয়ে রেখেছে বুন্দেলখণ্ডের পাথর আর মাটি। অভিমানিনী রানির পরাজয়ের লজ্জা লুকিয়ে রেখেছে জমিন…আমাদের মা। সরকারি ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রানিকে এক ভাবে দেখেছে, আর স্থানীয় গরিব মানুষেরা তাঁকে উপকথায় নিজেদের জীবনে বয়ে চলেছে।’
এই বই লেখার সময়েই মহাশ্বেতার সাথে রানির ভাইপো গোবিন্দ চিন্তামণি পাণ্ডের সাক্ষাত ও বন্ধুত্ব হয়। চিন্তামণির মারফত মহাশ্বেতা জানতে পারেন রানির কপালের অর্ধচন্দ্রাকৃতির জন্মদাগের কথা, কড়া পাকের ঘি খেতে পছন্দ করার কথা। জানতে পারেন রাজপরিবারের সেসময়ের নিজেদের নানা অন্তঃকোন্দলের কথাও। এই ভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন ভাবে তথ্য জোগাড় করে তৈরি হয় পাণ্ডুলিপি। যার পুরোটা দেখে দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। যা প্রথমে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সম্পাদক সাগরময় ঘোষের আগ্রহে ।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় শতবর্ষ পরে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘নিউ এজ’ থেকে বের হয়: ‘ঝাঁসীর রাণী’। দাম ছিল ২০ টাকা।