৮৩ বছরের বর্ষীয়ান ভারতীয় পরিচালক, শ্যাম বেনেগালের নাম চূড়ান্ত হয়েছে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীনির্ভর কাহিনিচিত্র (বায়োপিক)-এর পরিচালক হিসেবে। ২৭ আগস্ট সকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম যৌথ প্রযোজনার এই চলচ্চিত্রের জন্য ভারতের প্রস্তাবিত তিন পরিচালকের মধ্যে থেকে বর্ষীয়ান শ্যাম বেনেগালকেই বেছে নেওয়ার কথা জানান সংবাদমাধ্যমকে। আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমাটির যৌথ প্রযোজক বাংলাদেশ সরকার বা ভারত সরকার কেউই এখনও পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে নিযুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। যদিও স্যোশ্যাল মিডিয়ায় বায়োপিকের পরিচালক ঘোষিত হওয়ার সংবাদেরই প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কেউবা প্রশ্ন তুলছেন।
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান যে, মহাত্মা গান্ধি- জওহরলাল নেহরু-সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নিজ দেশের একাধিক জাতীয় নেতাদের নিয়ে সিনেমা করেছেন বলেই ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা বেনেগালের ব্যাপারে আগ্রহী ভ্রাতৃপ্রতীম বন্ধুরাষ্ট্র দু’দেশের সরকার। এছাড়া একাধিক সরকারের সরকারি উদ্যোগে নির্মিত যৌথ প্রযোজনার সিনেমার হালও সামলেছেন তিনি, বিবেচিত হয়েছে সেটাও।
বিজ্ঞাপনচিত্রের নির্মাতা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার পর নিজের নির্মিত প্রথম সিনেমা অংকুর (১৯৭৪)-এর মাধ্যমে দর্শকদের নিজের জাত চিনিয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল। সেই একই সিনেমা দিয়েই হিন্দি ভাষায় ভারতীয় প্যারালাল সিনেমার নিজস্ব যাত্রার সূত্রপাতও ঘটে বলে মনে করেন সিনেমার ইতিহাসে আগ্রহীরা। পূর্ণাঙ্গ বায়োগ্রাফিকাল বা জীবনীমূলক কাজ করা শুরু করেন মূলত: ১৯৭৭ সালে। সে বছরে মারাঠি থিয়েটারের বিখ্যাত অভিনেত্রী হঙসা ওয়াদেকারের জীবনের ফিকশনাল রিপ্রেজেন্টেশন থেকে তৈরি হয় এক সিনেমা, নাম ‘ভূমিকা’। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে নিয়ে সোভিয়েত পরিচালক ইউরি আলদোখিনের সাথে মিলে নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র ‘নেহেরু (১৯৮৫)’। ভারতের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেছেন জওহরলাল নেহেরুর বিখ্যাত বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’-এর ভিত্তিতে ‘ভারত: এক খোঁজ’। ১৯৮৮ সালে শুরু হয় ৫৩ পর্বের সেই ধারাবাহিকের সম্প্রচার। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির মহাত্মা পূর্ব জীবন নিয়ে তৈরি করেছেন সেমি ফিকশনাল ‘দ্য মেকিং অব দ্য মহাত্মা (১৯৯৬)’।
চলুন না, এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক এযাবত শ্যাম বেনেগালের তৈরি বায়োপিকগুলোর।
ভূমিকা (১৯৭৭)
বড় পর্দায় নিজের অভিনয়ের জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার জেতেন স্মিতা পাতিল। অনন্য-আলোচিত-সমালোচিত মারাঠি অভিনেত্রী হঙসা ওয়াদেকারের জীবন নিয়ে নির্মিত এই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনি চিত্রের উৎস ছিল মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘সাঙটিয়ে আইকা’। সিনেমায় আরও ছিলেন পুনে ফেরত সেসময়ের জনপ্রিয় সব অভিনেতারা। অমল পালেকর, অমরীশ পুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ ও অনন্ত নাগেদের অনেকেরই প্রথম হিট সিনেমার নাম, ভূমিকা।
নেহেরু (১৯৮৫)
তিন পর্বে বিভক্ত এই তথ্যচিত্রের যুগ্ম পরিচালক ছিলেন শ্যাম বেনেগাল। সাথে ছিলেন সোভিয়েত পরিচালক ইউরি আলদোখিন। এটিও দুই বন্ধু দেশ ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রদর্শিত হলেও আনুষ্ঠানিক মুক্তির তারিখ নিয়ে সামান্য জটিলতা রয়েছে প্রামান্য চিত্রটির। সিনেমার নান্দীপাঠ করেছিলেন নেহরু কন্যা ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধি। পুরো চিত্রনাট্যটাই তৈরি হয়েছিল জওহরলাল নেহেরুর নিজের লেখা ও বক্তৃতার ওপর ভিত্তি করে। ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা সৈয়দ জাফরি।
সত্যজিৎ রায় (১৯৮৫)
ভারতের সরকারি সংস্থা ফিল্ম ডিভিশনের প্রযোজনায় শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেছিলেন তথ্য চিত্র সত্যজিৎ রায়। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া বহুল প্রশংসিত ও সেদেশের জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ তথ্যচিত্রটি দেখতে ইউটিউব নয়, প্রযোজন পড়বে ডিভিডির। আর সেই ডিভিডির হদিস পাওয়া যাবে নিচে।
http://filmsdivision.org/shop/satyajit-ray
সরদারি বেগম (১৯৯৬)
১৯৮০ সাল থেকে অভিনয় শুরু এবং সে বছরেই বিদায় বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রায় ১৬ বছর পর ১৯৯৬-এ শ্যাম বেনেগালের ছবি ‘সরদারি বেগম’-এ অভিনয়ের মাধ্যমে কামব্যাক করেন কিরন খের। একই সিনেমাতে পান ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও। সিনেমার ঠুমরি-দাদরা শিল্পী সরদারি বেগমের গল্পটাও নাকি সত্যি এক ঘটনা থেকেই নেওয়া। অন্তত এমনটাই দাবি করছে ভ্যারাইটি। দুর্দান্ত সংগীতের জন্যেও দারুণ আলোচিত হয়েছিল সিনেমাটি। কিরন খের ছাড়াও অভিনয়ে ছিলেন রজিত কাপুর, অমরীশ পুরি, রাজেশ্বরী সচদেব। নিচেই দেখে নিতে পারেন আস্ত সিনেমাটি।
জুবেইদা (২০০১)
যোধপুরের মহারাজা হনুবন্ত সিং রাঠোরের মুসলিম ও অভিনেত্রী স্ত্রী জুবেইদা বেগমের জীবন নিয়ে ২০০১ সালে শ্যাম বেনেগাল নির্মাণ করেন পূর্ণদৈর্ঘ্য এক চলচ্চিত্র। কারিশমা কাপুর অভিনয় করেছিলেন নাম চরিত্রে, সাথে ছিলেন রেখা, মনোজ বাজপেয়ী ও রজিত কাপুর। এ. আর. রহমানের করা সংগীতের জন্য জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি এই সিনেমা জিতে নিয়েছিল সেবছরের সেরা হিন্দি সিনেমার জাতীয় পুরস্কারও। কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বাস্তবের জুবেইদার প্রথম পক্ষের সন্তান ও আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক ও ভারতের অসম্ভব জনপ্রিয় ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক খালিদ মোহাম্মদ। এই সিনেমাটির দর্শন পেতেও তালাশ করতে হবে ডিভিডির। আপাতত একটা গান শুনে রাখুন।
দ্য মেকিং অব দ্য মহাত্মা (১৯৯৬)
ব্যারিস্টারি পড়ে কর্মসূত্রে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন গান্ধি। প্রথম শ্রেণির টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে উঠতে দেওয়া হয়নি ট্রেনে। শিকার হয়েছিলেন বর্ণবিদ্বেষের। সেখানেই শুরু করেন প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই শুরু করেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক হওয়া কিংবা অহিংস লবন সত্যাগ্রহের পথকে সম্মান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারিত ‘মহাত্মা’ শব্দটির আগের মানুষটিকে নিয়ে ১৯৯৬ সালে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের যৌথ প্রযোজনায় শ্যাম বেনেগাল নির্মাণ করেছিলেন দ্য মেকিং অব মহাত্মা। নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রজিত কাপুর। ফাতেমা মীরের রচিত ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিসশিপ অব মহাত্মা’-এর থেকে নেওয়া হয় কাহিনি। ট্রেইলারের দেখা পাবেন নিচে।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটেন হিরো (২০০৪)
শ্যাম বেনেগাল ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটেন হিরো’ কাহিনিচিত্রটি তৈরি করেন ২০০৪ সালে। ভারতীয়দের বিশেষত ভারতীয় বাঙালিদের কাছে নেতাজি মানে বিল্পব। দেশের জন্য কেবল প্রাণ দেওয়ার থেকে বিপক্ষের প্রাণ নেওয়াতেও পিছপা না হওয়া। এমন ভাবেই পরাধীন দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। গান্ধির নীতি থেকে সরে গেলেও দেশের মানুষের মন থেকে তিনি হারিয়ে যাননি। সেই নেতাজির জীবনের সবচেয়ে আলোচিত-অনালোকিত অংশকে ঘিরে বায়োপিক তৈরি করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। সুভাষ চন্দ্র বসুর ভূমিকায় মারাঠি অভিনেতা শচিন খেদকরের অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয় সমালোচকদের কাছে। পুরো সিনেমাটিই পাওয়া যায় ইউটিউবে।
তো এমন ফিল্মোগ্রাফি নিয়ে জাতির পিতার হিমালয়সম ব্যক্তিত্বকে সেলুলয়েডে কিভাবে আবদ্ধ করেন শ্যাম বেনেগাল সেটা দেখতেই আগ্রহী না হওয়াও অস্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হবে ২০২০ সালের মার্চে। তার আগেই শ্যাম বেনেগালের নির্মিতব্য সিনেমাটি মুক্তি পাবে বলে প্রযোজক দু’ দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত আগেই গৃহীত হয়ে রয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শ্যাম বেনেগাল কতটুকু পেরে ওঠেন সেটাই বিচার্য আবার অনেকের কাছে।