বছরের সেই সময়টা চলে এসেছে যখন দেশজুড়ে অধিকাংশের মনে বাজছে কিশোর কুমার, আজিজ নাজানের কণ্ঠে ভিনোদ খান্না আর ফিরোজ খানের অমর পরিবেশনার সেই ঝংকার- “কুরবানি, কুরবানি, কুরবানি… আল্লাহ্ কো পেয়ারি হ্যায় কুরবানি…।”
তো এই কুরবানি নিয়ে যখন লিখতে বসেছি তখন অবধারিতভাবেই চলে আসবে বিরাট গরু-ছাগলের হাটের প্রসঙ্গ। যেখানে বিরাট বিরাট যেসব গরু বা ছাগল গর্বের সাথে বিচরণ করেন এবং তাদের চেয়েও বিরাট গর্বে গর্বান্বিত থাকেন তাদের ব্যাপারীরা। হাটের শেষদিনের আগে তাদের পোষ্য গরুগুলো এক একজন যেনো আইপিএল-এর আইকন প্লেয়ার। দাম একটুও পড়ার চান্স নেই। পোষালে নেন, নইলে ছোটোখাটো কাজ চালানোর মতো প্লেয়ারদের নামমাত্র দামে নিজের বাসার গ্যারেজে ঢোকান। (এই রে, এই বলে আবার কারো কারো ক্রিকেটানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেললাম না তো?)
সে যাকগে। ব্যাপারীদের দোষ দিয়েই বা হবে কি? হাটে হাটে ঘাঁটি গাঁড়বার আগে নানা ঘাটে উপুর্যপুরি সেলামি বিতরণের পর যা অবস্থা হয় তাতে গরুর বেশি দাম হাঁকানো ছাড়া উপায় কি? হাট-অভিজ্ঞতা আমার নেহায়েৎ কম। তবে যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে গরুর ব্যাপারীদের আমার কাছে বেশ রসিক শ্রেণিরই মনে হয়েছে। তাদের কাছে মনপসন্দ দাম না বলার মানেই হচ্ছে ঢাকাইয়া গাড়োয়ানদের স্টাইলে “ছাব, আস্তে কন্, হুনলে আমার গাভী ভি হাসবো” শোনার অপেক্ষায় থাকা। আপনি যে দামই বলবেন তাতে তার দিল ভরবে না। এরপরও যদি বা তার গরুতে খুশি হয়ে এবং ব্যাপারীকে কিঞ্চিত খুশি করে গরুর দড়ি হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, খুশি করতে হবে পথচলতি উৎসুক জনতাকে। ফেসবুক জামানা শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই জনতা আপনার গর্বের পোস্টে (গরু যে খুঁটিতে বেঁধে রাখেন তাকে কিন্তু ইংরেজিতে পোস্ট-ই বলে) লাইক, কমেন্ট, রিপ্লাই, রিঅ্যাকশন দিয়ে আসছেন। বুঝতে পারার কথা। না বুঝলে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ফেসবুকে আপনি তা-ই শেয়ার করেন যাতে আপনি নিজে গর্বিত কিংবা এমন কিছু যা বাকিদের জানাতে চান। কোরবানির গরুর চেয়ে বড় গর্বের আর কি আছে? তো এই গরু নিয়ে হাট থেকে বের হতেই আপনার প্রাইডের শেয়ারে প্রথম কমেন্ট- “ভাই কতো হলো?”। সে কমেন্টে রিপ্লাই দিলেন গরুর দাম জানিয়ে। সাথে সাথে হাতের ইশারায় কিংবা ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে জেনে যাবেন কমেন্টকারীর রিঅ্যাকশন। এই এত সুন্দর লাইভ ইন্টারঅ্যাকশন থেকেই মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট, রিপ্লাইয়ের ধারণাটা পাননি এ কথা কে পারবে বুকে হাত দিয়ে বলতে?
আবার ধরুন ফেসবুকে আপনার পোস্টও অনেক সময় হতে পারে অন্যের ঈর্ষার কারণ। গরু নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অন্যের আরেকটু বেটার গরু দেখে মাঝেমধ্যে এমনটা ফিল হতে পারে। সেটাও কিন্তু ফেসবুক শুরুর আগে থেকেই আমরা জানি।
অনুপ্রেরণার গল্প আরো আছে। কুরবানির অন্তর্নিহিত ত্যাগের তাৎপর্য অনেক ব্যাপক, অনেক মহান। তবে অন্তরের পাশবিক প্রবৃত্তিকে ত্যাগের এই চর্চ্চাকে পালন করতে গিয়েও অনেক সময় ভেতরের কিছু প্রবৃত্তি বেরিয়ে আসে। প্রায়শই নানা প্রাণির ফিল্টারে নিজেদের পরিবর্তিত করে তুলি। কখনো বা আবিষ্কৃত হয় কিছু ফিল্টারের প্রেরণা এসেছে গরুর হাট থেকেই।
ইন্টারনেট জুড়ে এমন আরো অনেক কুরবানি ইনস্পায়ার্ড মিম আর ট্রল ভরে গেছে। এটাই তো সময় সেগুলো উপভোগের।
তবে যতো যা-ই করেন, এই চাচার চেয়ে বেশি স্মার্ট হতে পারবেন না আশা করি।
যদিও এই দৌড়ঝাঁপের জীবনে ইদ মানে একটা ছুটির দিনই তো।
সবাইকে ইদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা।