পাকিস্তান নামের ভৌগোলিক উদ্ভট এক রাষ্ট্র তখন উদ্ভট উটের পিঠে, পশ্চিমের শোষণে পিষ্ট। তারই মধ্যে মিরজাফরের বংশধর ইসকান্দার মির্জাকে হঠিয়ে সে বছর মসনদে বসলো নয়া সামরিক জান্তা, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক অখ্যাত পশতুন জমাদারের পুত্র (ভবিষ্যতের স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল) আইয়ুব খান।
এদেশের গণতন্ত্রপসন্দ জনতার অবস্থা তখন ফুটন্ত কড়াই থেকে রীতিমত জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো। যদিও বীর বাঙালির বীরত্ব দেখানো কিন্তু কমেনি! বাঙালি শারীরিকভাবে দুর্বল, খেলাধুলা পারে না এইসব বলা দুর্মুখদের মুখে ছাই দিয়ে বিক্রমপুরের পোলা ব্রজেন দাস সাঁতরে ইংলিশ চ্যনেল পার হয়ে গেলেন। পুরান ঢাকায় বড় হওয়া এই আশি টাকার তোলা পোলা নিয়মিত সাঁতরাতেন বুড়িগঙ্গায়, এমনকি সাঁতরে নাকি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত চলে যেতেন। প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া এশিয়ান কেবল নন, ইতিহাসের প্রথম মানুষ হিসেবে ছয়বার তিনি সেই চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন।
দুনিয়ার অন্যান্য প্রান্ত তখন Cold War নামক বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আরেক উত্তেজনায় মত্ত, বিভ্রান্ত। মাটির পৃথিবী ছাড়িয়ে সে যুদ্ধ পৌঁছে যায় মহাকাশেও। বছরের শুরুতেই মহাশূন্যে রাশিয়ার পাঠানো বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ভেঙ্গে পড়লেও তার মাস দুয়েক পরেই যুক্তরাষ্ট্র বিপুল উদ্যামে নিজেদের প্রথম উপগ্রহটি পাঠায় মহাজগত জয়ে।
এইসব মহাজাগতিক যুদ্ধের মধ্যেই আদি যুগ থেকে লড়াই করে আসা মধ্যপ্রাচ্যর লোকজন আদিম বন্যতার সঙ্গে পরস্পরের বিরুদ্ধে হানাহানিতে লিপ্ত ছিলো। এইসবের মধ্যে বার্ট্রান্ড রাসেল পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণের বিরুদ্ধে একক ও মানবিক এক লড়াই শুরু করলেন, আর হিটলারের পোপ বলে পরিচিত ভ্যাটিকানকে ফ্যাসিস্টদের পালানোর রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত পায়াস ১২ গেলেন মরে। অবশ্য কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ, জোসেফ স্টালিনের সময় ভেজা বেড়াল হয়ে থাকা স্ট্যালিনগ্রাডের সেই বিখ্যাত যুদ্ধে সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা অফিসারের কাজ করা নিকিতা ক্রুশ্চেভ পেলেন স্যোশালিস্ট দেশটির শাসনভার।
ওদিকে ফিদেল কাস্ট্রোর বিপ্লবী বাহিনী শুরু করে কিউবার রাজধানী হাভানাতে গেরিলা আক্রমণ। হাঙ্গেরির বিপ্লবী ইমরে নেগিকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ঠিক হাইতির বিপ্লবীদের মতোই। সাম্রাজ্যবাদী ফরাসি বাহিনীকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে হঠিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা কায়েম করে সুদানিরা। এইসব হট্টরোলে সাহিত্যকর্ম থেমে থাকেনি। ব্রজেন দাস যেদিন সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হলেন ঠিক সেইদিনই মার্কিন মুলুকে প্রকাশিত হয় ভ্লাদিমির নবোকভের বিতর্কিত উপন্যাস ‘ললিটা’।
সেবছরে সাহিত্যে নোবেল পান আরেক রুশ, বরিস পাস্তেরনাক। জন লেনন নামের ব্রিটিশ এক ছোকড়া নিজের কয়েকজন স্কুলবন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলা ব্যান্ড দ্য কোয়ারিম্যানকে নিয়ে প্রথম পারফর্ম করে। পরবর্তীতে ব্যান্ডটার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বিটলস, আর বিটলসের নাম শোনেননি এমন মানুষ পৃথিবীতে পাওয়া দুষ্কর।
শুধু সাহিত্য আর সৃজনে নয়, জীবনধারাতেও শুরু হয় পরিবর্তনের এক নবযুগ। এই বছর আবির্ভাব হয় বারবি ডলের, আবিস্কার হয় দুনিয়ার প্রথম ভিডিও গেমস আর উদ্বোধন হয় প্রথম পিজা হাট। প্রথমবারের মতো জাহাজের চেয়ে বেশি লোকের বিমানে চেপে আটলান্টিক সমুদ্দুর পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড হয় এই বছরই। এমন শতশত পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে ফুটবলেও। হোয়াও হাভেলাঞ্জ নামের এক ব্রাজিলিয়ান এ বছরে সে দেশের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হন।
যিনি ঠিক এর দেড়দশক পরেই ফিফার সপ্তম প্রেসিডেন্ট হয়ে খেলাটার খোলনলচেই বদলে দেবেন। খেলাটাকে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক করার পেছনে এই বিতর্কিত চরিত্রের মানুষটির ভূমিকাই সবচেয়ে বড়, তবে সেটা অনেক পরের আলাপ। কাকতালীয়ভাবে সেই বছরে সেন্ট ক্লেয়ারকে টেলিভশনের পেট্রন সেইন্ট ঘোষণার পাশাপাশি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ। তবে এসব বাদে, খেলার মাঠে বিশ্ব ফুটবলকে এক ঝটকায় এক নান্দনিক শিল্পে পরিণত করেন হাভেলাঞ্জের দেশের একপাল তরুণ। দিদি, নিলটন স্যান্টোস, গারিঞ্চা, পেলেদের খেলায় মুগ্ধ হয় গোটা বিশ্ব।
এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতি লাভ করেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য, ১৭ বছরের পেলে, যিনি নয় বছর বয়সে, ১৯৫০ সালে মারকানার সেই অভিশপ্ত দিনে নিজের বাবাকে বলেছিলেন তিনি ব্রাজিলের দুঃখ ঘুচাবেন। অথচ এই দুই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, পেলে আর অনেকের মতে তার চেয়েও ভালো খেলোয়াড় গারিঞ্চাকে মানসিক অপরিপক্কতার অজুহাতে দলেই নেওয়া হয়নি প্রথমে। শেষমেশ নতুন কোচ ভিসেন্তা ফিওলা তাদের দলে নেন। ব্রাজিলের এই দলটি কিশোর পেলের প্রতিজ্ঞা পূরণ করে শুধু ব্রাজিল নয় বরং সারা দুনিয়াকে আনন্দে ভাসায়।
তাদের খেলা দেখে লন্ডনের ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসে লিখেছিল, এই জিনিস দেখার পর আপনাকে চোখ ডলে নিয়ে আবার তাকিয়ে দেখতে হবে- নচেৎ বিশ্বাস হবে না যে এইটা এই দুনিয়ার কিছু! সুন্দর ফুটবলের আগমনী উপলক্ষ্য হয়ে এলো যেন সুইডেনের সেই বিশ্বকাপটা। পরিবর্তনের দুনিয়ায়, সুন্দর ফুটবলের বিশ্বজয়ের বিশ্বকাপ। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে শ্রেষ্ঠত্ব ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার বীরত্বের বিশ্বকাপ। এটা ১৯৫৮ বিশ্বকাপের গল্প।
সেবারেই টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজিত হলো। জুনের ৮ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত ১২টা ভেনুতে ১৬ দলের মোট ৩৫টা খেলা। স্বাগতিক সুইডেন আর চ্যম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি পেলো সরাসরি খেলার সুযোগ। বাকি ১৪ দলের নয়টা ইউরোপের, তিনটা দক্ষিণ আমেরিকা আর উত্তর/মধ্য আমেরিকা ও এশিয়া/আফ্রিকা থেকে একটি করে দল। তবে এশিয়া/আফ্রিকা অঞ্চলে টানা ওয়াক ওভার পাওয়া ইসরায়েল প্লে অফে হারে ওয়েলসের কাছে, তাই সেই বিশ্বকাপে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মহাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কোন দেশই শেষতক খেলেনি। সেবারেই প্রথম দুই মহাদেশ মিলিয়ে বিস্তৃত দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বকাপে অংশ নিলো আর ব্রিটিশদের চারটা দেশ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ঊত্তর আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস সুযোগ পেলো চূড়ান্ত পর্বে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বল নিয়ে খেলার বীরত্ব সেই প্রথম, সেই শেষ!
এবারেও শুরুতেই আর্জেন্টিনা আয়োজক হতে চেয়ে শেষমেশ পিছিয়ে গেলেও বিশ্বকাপটা বয়কট করেনি। ফলশ্রতিতে, ১৯৩৪ সালের পর প্রথম তারা বিশ্বকাপে খেলতে ফিরলো। অবশ্য, ইতালি এবার বাছাই পর্বই পার হতে পারেনি। ফুটবলপাগল এই দেশটি টেলিভিশনে আস্ত বিশ্বকাপ দেখার তেতো স্বাদ পাচ্ছে আবার ঠিক ৬০ বছর পর, ২০১৮ সালে। ইউরোপের আরও দুইটি পাওয়ারহাউস স্পেন ও বেলজিয়ামও বাদ পড়ে কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলো দুইবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের বাদ পড়া। প্রথমদিনের খেলাতেই বোঝা যাচ্ছিলো, নতুন যুগের ফুটবলটা কতো দুর্দান্ত হতে যাচ্ছে। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি আর্জেন্টিনাকে হারায় ৩-১ গোলে, আর তাতে দুই গোল দেন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দলের কাপ্তান, জার্মান ফুটবলের ‘দি বস’ হেলমুট রাহন। তবে একগোল দেয়া তরুণ উয়ে সিলার যে অচিরেই জার্মান কিংবদন্তী হতে চলেছেন সেটা বোঝা যাচ্ছিলো।
এ বিশ্বকাপের আরেক রূপকথার গল্পটা শুরু হলো গ্রুপ বিতে। জুষ্ট ফন্টেইন নামে মরক্কোতে জন্ম নেয়া এক ফরাসি করলেন হ্যাটট্রিক। প্যারাগুয়ে হারলো ৭-৩ গোলে। এরপর প্রতিটি ম্যাচে শুধু তার গোল করার গল্প, ফ্রান্স শেষমেশ জিতলো না ঠিকই, তবে ফন্টেইন মাত্র ৬ খেলায় দিলেন ১৩ গোল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে এতো গোল আর কেউ কোনদিন করতে পারেনি। পারবেও না সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ফন্টেইন বিশ্বকাপের ইতিহাসে ক্লিশে হয়ে যাওয়া ‘গোল মেশিন’ খেতাবটির সত্যিকারের দাবিদার হিসেবে বিবেচিত হলেও তার সহখেলোয়াড় রেমন্ড কোপা ছিলেন ইউরোপীয় গ্রেট। সে বছর ব্যালন ডি অর জেতা কোপা খেলতেন টানা পাঁচবার ইউরোপ জেতা দল রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। কোপাকে বলা হতো ‘নেপোলিয়ন অফ সকার’, কারণ তিনি নাকি নোপোলিয়নের মতোই খর্বকায় হলেও গোটা মাঠটাই দখলে রাখতে চাইতেন। ধারাভাষ্যকাররা তার খেলার বিবরণ দিতো ল্যাটিন নৃত্যের উপমা দিয়ে, বল নিয়ে তার খেলাটা ছিলো এতটাই আনন্দের। পোলিশ অভিবাসীর সন্তান কোপার শৈশবটা কেটেছিলো কয়লা খনির মজুর হিসেবে। তাই হয়তো ফুটবলের আলো দিয়ে দুনিয়াটা রাঙ্গাতে এতোটা উদগ্র ছিলেন তিনি। একই সময়ে জোগো বনিতার আলোয় রাঙ্গা হলো সুইডেন। ব্রাজিলের কাছে গ্রুপ ডির প্রথম খেলায় ৩-০ গোলে হারলো অস্ট্রিয়া। এই গোলগুলোর একটি ছিলো নিল্টন স্যান্টোসের। ফুটবল নিয়ে বিস্তর জানাশোনার জন্য ব্রাজিলের ডিফেন্সের এই মূল স্তম্ভকে সবাই ডাকতেন,‘দি এনসাইক্লোপিডিয়া’। আর সত্যিকারের জ্ঞানীরাই পুরনো নিয়মের নব নব সৃজন করেন। যার প্রমাণ নিল্টন স্যান্টোস। ডিফেন্ডারের তথাকথিত ‘স্থবির’ খেলা বাদ দিয়ে খেলার ৫০ মিনিটের মাথায় তিনি বল নিয়ে দৌড় দেন, দুইজন বিপক্ষ খেলোয়াড়কে কাটান, আর দৌড়তেই থাকেন। ওদিকে মোটাসোটা কোচ ফিওলা সাইডলাইনে ঘেমে, নেয়ে, হয়রান হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিলটনকে ‘নিজের জায়গা’ ডিফেন্সে ফিরে যেতে বলেন। নিল্টনের এই কথা শুনতে বয়েই গেছে! আর কাউকে পাস দেওয়ার তোয়াক্কা না করে, বিপক্ষের ডিফেন্ডারগুলো খেলিয়ে, গোলকিপারকে বুদ্ধু বানিয়ে বলটাকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি ফিরলেন ‘নিজের জায়গায়’। পথে সাইডলাইনে এসে, ফিওলার দিকে চোখ টিপ দিয়ে বলে গেলেন, ‘কি জানি কইতাসিলেন উস্তাদ, ঠিকমতো হুনিনাইক্কা’।
নিল্টন তো তাও ডিফেন্ডার ছিলেন, তিনি একটু আধটু উপরে উঠতেও পারেন, কিন্তু আমাদেও কারিজো তো ছিলেন গোলকিপার! তবুও এই আর্জেন্টাইন হুটহাট উপরে উঠে যেতেন। এমনকি বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ড্রিবল করে নিজের দলের হয়ে গোলও দিতেন! পরের যুগে হিগুইতা আর চিলাভার্টরা আসলে কারিজোরই অনুসারী। তিনি ছিলেন নিজের দেশে সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার আর এই প্রেরনাদায়ী, আনন্দদায়ী মানুষটি ছিলেন সকলের কাছেই প্রিয়। তবুও সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শেষটা ভালো হলো না। আর্জেন্টিনার দুর্বল দলটি গ্রুপের শেষ ম্যাচে যুগোশ্লাভিয়ার কাছে ৬-১ গোলে পর্যদুস্ত হলো। এসব ক্ষেত্রে যা হয়! দেশে ফেরার পর যুপকাষ্ঠে তোলা হলো কারিজোকে, যিনি বর্নাঢ্য ক্যারিয়ার শেষ করে বলেছিলেন, ‘আমার কেবল ওদের দেওয়া গোলগুলাই মনে আছে, আমি যেগুলো ঠেকিয়েছি সেগুলা আমার স্মৃতিতে নেই’। এমনটাই জীবন আসলে গোলকিপারদের!
যাই হোক, জার্মানির সঙ্গে গ্রুপ এ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে গেল চেকদের প্লে অফে হারানো নর্দান আয়ারল্যান্ড। বি গ্রুপে দুর্দান্ত ফ্রান্সের সঙ্গে গেল ফ্রান্সকেই হারানো যুগোশ্লাভিয়া, সি গ্রুপ থেকে গেল স্বাগতিক সুইডেন আর ওয়েলস। অন্যদিকে ডি গ্রুপ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলো ব্রাজিল আর প্লে অফে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে রানার-আপ হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রাজিলের খেলায় দুইটি গোল দিলেন ভাভা। সেই দুর্দান্ত দলে ছিলেন ভাভা, মারিও জাগালো, দুনিয়ার অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার জিলমা সান্টোস, হিদেরাল্ডো বেলিনি। আর নিল্টন, দিদি ও গ্যারিঞ্চার কথা তো বলা হলোই। তবে ঐ ম্যাচে যেন অভিষেক হলো পেলের। আর তিনি গোল পেলেন কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের সঙ্গে। গোলের বন্যায় ভাসাতে থাকা ফ্রান্স ৪-০ গোলে জিতলো আরেক ব্রিটিশ দল নর্দান আয়ারল্যান্ডের সাথে। সুইডেন হারালো সোভিয়েতকে আর জার্মানি, যুগোশ্লাভিয়াকে।
টুর্নামেন্টে দারুন ফর্মে থাকা ব্রাজিল আর ফ্রান্সের সেমিফাইনাল খেলাটাকে ধরা হচ্ছিলো ‘আসল’ ফাইনাল হিসেবে। আশা করি হচ্ছিলো সেটি হবে টুর্নামেন্টের সেরা খেলা। হলোও তাই! ভাভা দুই মিনিটে গোল দিলেও ফন্টেইন শোধ দিলেন ৯ মিনিটের মাথায়। দিদির ৩৯ মিনিটের গোলে আবার ব্রাজিল লিড নিল। তবে এর পরে শুধুই ‘পেলে’ শো। তখনো প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া ছোকড়া ফরাসিদের চোখের জল, নাকের পানি এক করে হ্যাট্ট্রিক করে বসলেন। শেষদিকে ফ্রান্স একটা গোল দিলেও তাই ফলাফল ৫-২। ঠিক একই ফলাফল হলো ফাইনালেও! আজ অবধি এক ফাইনালের সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। সুইডেনের অধিনায়ক এরিক লিডহোম মাত্র চার মিনিটের মাথায় স্বাগতিকদের আনন্দে ভাসালেও ভাভা ও পেলের জোড়া গোল আর জাগালোর এক গোলে অধরা বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। সুন্দর ফুটবলের এক দল, যাদের খেলা দেখে খোদ সুইডিশ রাজা গুস্তাভাস আডোলফাসের নাকি মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিলো।
আর বিশেষজ্ঞদের মতে ব্রাজিলের এই দলের সেরা পারফরমার ছিলেন দিদি। আফ্রিকান দাসের বংশধর, সুঠামদেহী, লম্বা ঘাড়ের লোকটি ছিলেন ব্রাজিলের মাঝমাঠের স্তম্ভ। দিদির নিখুঁত ডিফেন্সচেরা পাসগুলো গোলে পরিণত করতেন পেলে, ভাভারা। তবে শুধু গোল দেওয়াতেই নয়, নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি আবিস্কার করেন ‘ঝরা পাতা’ ফ্রি কিকের। ব্রাজিলের নিজস্ব এই শিল্প আজও দুনিয়াকে বিমোহিত করে। দিদির পা থেকে বলটা ঘুরতে ঘুরতে শূন্যে উঠে, সেখানে কিছুক্ষণ নেচে বেড়িয়ে, দিক পরিবর্তন করে ঝুপ করে ঝরা পাতার মতো গোলপোস্টের এমন জায়গায় গিয়ে পড়তো যেখানে বলটাকে গোলকিপার সবচেয়ে কম আশা করছে। বল যেন দিদির সব কথা বুঝতো! বুঝবে নাই কেন?! বল ছিলো তার কাছে জীবন্ত সত্ত্বা। বল তো ছিলো দিদির প্রেমিকা। এক সাক্ষাতকারে দিদি নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ওকে যদি আপনি আদর না করেন, ও আপনার কথা শুনবে না। ও যখন আমার কাছে আসবে আমি তখন এগিয়ে যাবো আর আমি বললেই ও আমার কথা শুনবে। ও যখন অন্য দিকে যেতে চাইবে আমি ওকে বলবো, আমার সোনামানিক, এদিকে এসো, আর ওকে আমার দিকে নিয়ে আসবো। আমি ওর যত্ন করবো আর ও আমার কথা শুনবে। আমি ওকে ততোটাই ভালোবাসি যতোটা বাসি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। ওকে আমি ভালোবাসি কারণ ও হলো ‘আগুন’। ওর সঙ্গে যদি তুমি খারাপ আচরণ করো ও তোমার পা ভেঙ্গে দেবে। এইজন্যই আমি বলি, ছেলেরা, আসো, ওকে শ্রদ্ধা করো। ও এমন একটা মেয়ে যাকে আদরে ভরিয়ে দিতে হবে। ওর শরীরে তুমি ভালোবাসার স্পর্শ দিলেই না তোমাদের মধ্যে এক দুর্দান্ত ভালোবাসার গল্প তৈরি হবে’। দিদির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতেন তার সতীর্থ গারিঞ্চা আর পেলে।
এ দুজনের গল্পের জন্য সামনের বেশ কটি আসর বরাদ্দ। আজকে দ্বিগ্বিজয়ী দলটির গল্প অবশ্য শেষ হবে দিদির, ব্রাজিলের, ভালোবাসার বলটির কি গতি হয়েছিলো সেই কথা বলে।
দুর্দান্ত ফাইনাল জিতে ওরা বলটি উপহার দেয় মারিও আমেরিকাকে।
পাহাড়ের মতো দেখতে, আফ্রিকার বংশোদ্ভুত এই লোকটি ছিলো এই দলের ম্যাসাজম্যান। পরম যত্নে সে পেলে, গারিঞ্চাদের খেলা শেষে ম্যাসাজ করে দিতো। এমনকি মাঠে কেউ আহত হলে নিজের দানবীয় কাঁধে তুলে ওদেরকে মাঠ থেকে বেরও করে আনতো। শুধু খেলে জয় করা নয়, মাঠের বাইরের এই ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবাসার প্রতীক উপহার দিয়ে দিদি আর ব্রাজিল দল বুঝিয়ে দেয় আমাদের সমস্ত অর্জনের পিছনে পর্দার অন্তরালের অনেক ভালোবাসা, অনেক শ্রম আছে। এসব শ্রমে ঘামেই গড়ে উঠে একেকটা সৌধ। দিদিরা আবারো দেখান, ফুটবল সবসময়েই এক দারুণ সুন্দর মানবিক গল্প।