যাকে আজ আমরা বাংলা নামের দেশ বলে ডাকি সেখানে শিক্ষা আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে প্রাণ দেয় ছাত্র-শিক্ষক-জনতা। আজকের শিক্ষিত লোকেরা ভুলেই যায় যে সেই আন্দোলনে বাবুল নামে এক ‘কাজের ছেলেও’ অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। উত্তাল হয়ে উঠে পাকিস্তানের দু’প্রান্তই। সেই আন্দোলন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিকেও চাঙ্গা করে তোলে।
কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করে কেউই আর বাবুলদের কথা মনে রাখে না, ভুলে যায়। সেটা সহজ আর তাই অদ্যাবধি বাবুলদের শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার এ রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ওরা পিষ্ট হচ্ছে আগের মতোই। ঢাকা থেকে মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে রোহিঙ্গাদের যে দেশ, শরৎচন্দ্রের একসময়কার কর্মস্থল বার্মা মুল্লুকেও সে বছর ক্ষমতা আত্মসাৎ করে সামরিক জান্তা যা কার্যত আজ অবধি বহাল। অবশ্য এখন সেদেশের ভবিতব্য নিয়ে এই তল্লাটের দুই ওস্তাদ চীন আর ভারত শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই করছে! সে বছর ভারতে আবারো ডি ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন হ্যারোর চোস্ত ইংরেজি বলিয়ে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। তিনি তখন ঠান্ডা যুদ্ধের দামামার মাঝে কলোনির শাসন থেকে সদ্য স্বাধীন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র পুনর্গঠনে ব্যস্ত। একদিকে যদিও, জন মেইনার্ড কেইন্স নামের এক আমুদে, ফুর্তিবাজ ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদের দেখানো পথে, ব্রেটন উড নামের এক ছোট্ট মার্কিন গ্রামে সবুজ ডলারের তলোয়ারে শান দিচ্ছে দুনিয়ার ‘প্রভু’ হতে চাওয়া ‘প্রথম’ বিশ্ব। আরেকদিকে ‘টোটালিটারিয়ান’ সোভিয়েত মডেলে গড়ে ওঠা ‘দ্বিতীয়’ বিশ্বের সাম্যবাদ রপ্তানির যূথবদ্ধ চাপে তৃতীয় বিশ্ব তথা প্রাক্তন কলোনিগুলোও তখন জেরবার। এরই মধ্যে কিছুটা সোভিয়েত ঘেঁষা ভারতের সঙ্গে চেয়ারম্যান মাওয়ের দেশের সেনাবাহিনী সীমান্তে কদ্দিন ধরে ঠুসঠাস গুলি বিনিময় হয়। এও ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাবে আরেক নতুন ধরণের যুদ্ধ। এরকম যুদ্ধ তখন নানা দেশেই চলছিলো। বিশেষত আফ্রিকায়, যেখানে দেশগুলি জেঁকে বসা কলোনিয়াল প্রভুদের তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডি স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশদের ঠেঙ্গিয়ে স্বাধীন হলো উগান্ডার জনতাও। অবশ্য দুনিয়ার অন্যপ্রান্তের আরেক উগান্ডার লোকজন এখন খালি ফেসবুকেই বিপ্লব করে চলেছে! সে কথা থাকুক আজ। আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে তখন শুধু সেদেশেরই নয়, খোদ দখলদার ফ্রান্সের তরুণরাও রাস্তায় নেমে আসে। আর দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে আরব-আফ্রিকান দেশটাও সে বছরেই ফরাসিদের রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন পতাকা পায়। স্বাধীনতার এই ঢেউ আছড়ে পড়ে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলোতেও। একদা আফ্রিকা থেকে দলে দলে দাস বানিয়ে আখ চাষের জন্য নিয়ে যাওয়া মানুষগুলো জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো নামের দেশগুলোকে পায়, নিজের করে।
অবশ্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধের আশংকাটা বাঁধে আরেক ক্যারিবীয় দেশ কিউবায়। সমাজতান্ত্রিক দেশটা তখন ঠান্ডা যুদ্ধের শিখন্ডী হওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। ‘দুষ্টু’ কিউবাকে ‘শাসন’ করার জন্য মার্কিনিরা স্বভাবসুলভভাবে আগের বছরই বে অফ পিগস দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আংকেল স্যামের সাগরেদদের যমদূত, লাল ঝান্ডাধারী ফিদেল কাস্ট্রো উল্টো তাদেরই পিটিয়ে লাল বানিয়ে দেয়। এই শোকে প্রথমে হাইতিকে দেড় কোটি ডলার ঘুষের বিনিময়ে ভোট কিনে নিয়ে অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস থেকে কিউবা বের করে দিয়ে একঘরে করে এলাকার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে কিউবাও সোভিয়েতের থেকে মিসাইল ধার করে আনে। ঐ বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি দুই দেশের মধ্যে আরেকটু হলেই পারমাণবিক অস্ত্র চালাচালি হয়ে যেতো আরকি! এ থেকে বাঁধতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ! আর পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ দেশগুলোর এই মহাযুদ্ধ লাগলে, তেলাপোকা আর ইঁদুর ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন প্রাণি বেঁচে থাকতো কিনা সন্দেহ! শেষতক অবশ্য সেই যুদ্ধ আর হয়নি! ফিদেল, ক্রুশ্চেভ আর কেনেডিরা মিলে উল্টো সেসব মারণাস্ত্র নষ্ট করে ফেলার ব্যাপারে সম্মত হন।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না বাঁধলেও সে বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত নাজি কসাই আইখম্যানের ফাঁসি হয়। ফাঁসির পর ওর মরদেহ পুড়িয়ে সেই ছাই সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়। আইরনি হচ্ছে, সেই বছরই এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলে একটা সংগঠনের জন্ম হয়। নিধিরাম সর্দারের মতো ঢাল তলোয়ারবিহীন এই সংগঠন অবশ্য দুনিয়ার অনেক গরিব দেশে যুদ্ধাপরাধীদের ঝুলিয়ে দেওয়ার সময় এখন মানবধিকার-ফিকার বলে খুব চেঁচায়। তবে আইখম্যান নিয়ে কিন্তু ওরা টুঁ শব্দ করেনি। ওদের মানবিকতার জ্ঞান ভীষন টনটনে কীনা! ওরা জানে, দুনিয়ার সব মানুষের জীবনের মূল্য এক না! কিছু কিছু গণহত্যা আর সব গণহত্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দিন শেষে লাশ নিয়ে পলিটিক্স না বুঝলে তো আর ‘মানবতা’ দেখানো যায় না, তাইনা! অবশ্য লিনাস পাউলিং-এর মতো কিছু লোক এতো কিছু বুঝতেন না। এই বায়োকেমিস্টকে ঐ বছর দ্বিতীয়বারের মতো নোবেল পুরস্কার দিয়েও দমিয়ে রাখা যায়নি। এই গোঁয়ার মার্কিন বিজ্ঞানীর এক কথা! দুনিয়া থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল করতে হবে।
পাওলিং পুরোপুরি সফল না হলেও বলা চলে সেসময় দুনিয়ায় মোটামুটি একধরণের পরিবর্তনের, সমৃদ্ধির দখিনা হাওয়া বইছে। সে বছরটা হরেদরে ভালোই ছিলো। যদিও লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে হলিউড সুন্দরী মেরিলিন মনরো সে বছর সুইসাইড করলেন। লন্ডনের রেকর্ড কোম্পানি ডেকা বিটলসের গান রেকর্ড না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর হেনরি মিলারের বিতর্কিত উপন্যাস ট্রপিক অফ ক্যান্সারের রগরগে বর্ণনার বিরুদ্ধে ফ্রি স্পিচের দেশ আমেরিকায় একের পর এক মামলা হচ্ছে। এসবের মধ্যে মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক পেশাদার বক্সিং ম্যাচে কিউবার বেনি ‘দি কিড’ প্যারেট এতোটাই আঘাত পান যে কদ্দিন হাসপাতালে কোমায় থেকে মারাই গেলেন। এলভিস প্রেসলি ৩ কোটির উপর রেকর্ড বিক্রির পর এই বছর যান রিটায়ারমেন্টে।
মুক্তি পায় ডেভিড লিনের মাস্টারপিস লরেন্স অফ এরাবিয়া। অবশ্য সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আয়োজনটা হয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। সেখানে দুর্দান্ত ব্রাজিল দল আগেরবারের বিশ্বকাপটা নিজেদের দখলেই রেখে দেওয়ার লড়াইয়ে নামে, সাফল্যও পায়। জোগো বনিতোয় মুগ্ধ বিশ্ব দেখে টালমাটাল ষাটের দশকে সাম্বা আর ফুটবলের অনন্য যুগলবন্দি। বিশ্বকাপ ১৯৬২, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের সপ্তম সংস্করণ।
টানা দুইবার ইউরোপে আয়োজন হওয়ার পর মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মাত্র দ্বিতীয়বার ল্যাটিন আমেরিকায় বসা আসরটি নিয়ে চিলিয়ানরা বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তেজিত থাকলেও ১৯৬০ সালে সেদেশে ঘটে এক বিরাট ট্রাজেডি। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ভালভাডিয়া ভূমিকম্পে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয় আর বাস্তুহারা হন প্রায় ২০ লাখ লোক। স্বাভাবিকভাবেই টুর্নামেন্ট নিয়ে আগ্রহ কমে যায়, সরকারও খরচ কমিয়ে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আর টুর্নামেন্ট শুরুর পর সমর্থকদের জন্য হতাশা বয়ে নিয়ে আসে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর ইনজুরি। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তীকে অনেকেই বলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। এই জাদুকর টানা পাঁচবার ইউরোপ সেরা করেন তার ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদকে। সেবার ৩৬ বছর বয়সে তিনি স্পেনের হয়ে মাঠ মাতাতে চাইলেও ডান পায়ের ইনজুরিতে ছিটকে গেলেন। দুর্ভাগ্য ফুটবলামোদীদের।
বলা হতো ডি স্টেফানোর জুতা জোড়ায় নাকি গোটা ফুটবল মাঠই এঁটে যেতো। স্টেফানোর বুট থেকে কুঁড়ি থেকে ফুল ফুটতো। আর মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে অবিশ্রান্ত দৌড়ে যেতেন ‘সাদা তীর’ নামে পরিচিত এই খেলোয়াড়টি। পায়ে বল আসার পর স্থান আর গতি পরিবর্তন করতেন। আগের মূহুর্তে অলস কচ্ছপ হয়ে থাকা পা জোড়ায় যেন সাইক্লোন ভর করতো। আর মার্কারকে এড়িয়ে ফাঁকা জায়গায় বল পাওয়াটা তার জন্য ছিলো একেবারেই ছেলেখেলা। তিনি যখন আক্রমণে যেতেন তখন দর্শকেরা চেঙ্গিস খানের বাহিনীর ঘোড়াগুলোর অদম্য গতি আর ধূলিঝড়ের পুনরাবৃত্তি দেখতো। আর তার গোলগুলি ছিলো নাকি রঙধনুর মতো। বেগুনী গোল, নীল গোল, আসমানি গোল, সবুজ গোল, হলুদ গোল, কমলা গোল আর টকটকে লাল গোল! এই ছটা দেখে দর্শকেরা কবিতা পড়তো-
‘ঐ দেখ আসছে
ছুটে আসা তীর
নাহ! ছুটে আসা তীরও
ওর চেয়ে ঢের ধীর!’
অথচ খেলা শেষে ডি স্টেফানো কখনোই নিজ পায়ে হেঁটে মাঠ ছাড়তে পারতেন না। মনোমুগ্ধ দর্শকদের কাঁধই ছিলো তার খেলা শেষের ঠিকানা।
স্পেন দলটাতে সেবার শুধু স্টেফানোই নন, ছিলেন হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া ফেরেঙ্ক পুসকাসও। সেই ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সদের নেতা! হাঙ্গেরিতে অশান্তি শুরুর পর স্পেনে ঠাঁই নেওয়া স্টেফানোর সমবয়সী পুসকাসও খেলতে চাইলেন স্পেনের হয়ে, কিন্তু তেমন কিছুই করে উঠতে পারলেন না।
এই দলের কোচও ছিলেন একজন আর্জেন্টাইন, অনেকের মতে সর্বকালের সেরা, হেলেনিও হেরেইরা। অথচ তাও স্পেন পেলেবিহীন ব্রাজিলের কাছে ২-১ গোলে হেরে গ্রুপ থেকেই বিদায় নিলো। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর সঙ্গে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে একটা গোল দিলেও যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে পরের ম্যাচে চোট পান পেলে। অবশ্য, আমেরিলডো তার জায়গায় এসে স্পেনকে দুই গোল দিয়ে দলকে পরের রাউন্ডে তুলে দেন।
এতো গেলো গ্রুপ সি-এর কথা। ৩০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত চলা ঐবারের টুর্নামেন্টেও আগেরবারের মতোই ষোলটা দল চার গ্রুপে খেললো। স্বাগতিক চিলি আর চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার আরো তিনটা দেশ আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া আর উরুগুয়ে, কনকাকাফের মেক্সিকো আর বাকি দশটা দেশ ইউরোপ থেকে। গ্রুপ এ-তে সোশ্যালিস্টদের জয়জয়কারের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুগোশ্লাভিয়া, দুই ল্যাটিন দেশ উরুগুয়ে আর কলম্বিয়াকে পেছনে ফেলে কোয়ার্টারে উঠে গেলো। গ্রুপ ডি থেকে কোয়ালিফাই করলো হাঙ্গেরি আর ইংল্যান্ড। আর সেখানে ইংল্যান্ডের কাছে হেরেই বাদ গেলো আরেক ল্যাটিন দল আর্জেন্টিনা। যদিও সেই খেলাটা বিখ্যাত হয়ে থাকবে ববি চার্লটনের কারণে। খেলার ৪২ মিনিটে বামদিক দিয়ে এক দুর্দান্ত দৌড়ে আর্জেন্টিনার ডিফেন্সকে তিনি তছনছ করে দেন আর শেষ মুহূর্তে বা থেকে ডান পায়ে বলটা নিয়ে গোলকিপারের পাশ দিয়ে দুর্দান্ত এক গোল করেন। অথচ এইরকম একটা গোল দেওয়ার পরে চার্লটন আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কে জানে, হয়তো কাঁদছিলেনও! তার তো বেঁচেই থাকার কথা ছিলো না, খনিমজুরের পুত্র ববি চারবছর আগে সেই অভিশপ্ত বিমানের যাত্রী ছিলেন, মিউনিখের পথে থাকা সেই বিমানে তার দল ম্যাঞ্চেষ্টার ইউনাইটেডের আটজন খেলোয়াড়সহ মোট তেইশজন মারা যান। ফুটবলের ইতিহাসে চরম এই দুঃখজনক দিনটার কথা হয়তো মনে করছিলেন বসবি বেবস নামে পরিচিত কোচ ম্যাট বসবির দলের সেরা খেলোয়াড় ববি। চার্লটনের এই অলৌকিক বেঁচে যাওয়ার চূড়ান্ত ফলাফল আমরা জানবো আর চার বছর পর (মানে পরের পর্বেই)। আপাতত আরেকটা গ্রুপ, গ্রুপ বি-তে ফিরে যাওয়া যাক।
সান্টিয়াগোর এস্তাদিও ন্যাশনালে ২রা জুন স্বাগতিক চিলি বনাম ইতালির খেলাটা এতোটা জঘন্য রুপ নিলো সেই খেলাটাকে আখ্যা দেয়া হয় ‘ব্যাটল অফ সান্টিয়াগো’ বলে।
মূলত ভূমিকম্পের পরও চিলিকে আয়োজক রাখায় ইতালির পত্রপত্রিকায় ফিফাকে যাচ্ছেনাতাই গালমন্দ করা হয়। এরপর খেলা শুরু হলে ইতালির সাংবাদিকরা চিলির দারিদ্র্য এবং অব্যবস্থাপনা নিয়ে কটাক্ষ করে লিখতেই থাকে। যার প্রভাব পড়ে খেলার দিন। ব্রিটিশ রেফারি কেন এস্টন দুইজন ইতালীয় খেলোয়াড়কে বহিস্কার করেন। গণ্ডগোল থামাতে পুলিশকে চারবার মাঠে আসতে হয়। শেষতক চিলি ২-০ গোলে জেতে আর পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে। তারপরের ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জিতে সেমিতেও উঠে যায় চিলি। চেকরা হারায় হাঙ্গেরিকে, দুর্দান্ত ব্রাজিলের সঙ্গে হারে ইংল্যান্ড আর যুগোশ্লাভিয়া হারায় পশ্চিম জার্মানিকে। ব্রাজিলের খেলায় অদ্ভুত দ্যুতি ছড়িয়ে দেন গ্যারিঞ্চা বা ‘ছোট্ট পাখি’। এক দঙ্গল ভাইদের মধ্যে একজন তার নাম দিয়েছিল গ্যারিঞ্চা। কুৎসিত, অকর্মা, ছোট্ট একটা পাখির নামে। কিন্তু বিশ্বের কাছে গ্যারিঞ্চা, ক্ষুধা আর পোলিওকে জয় করা গ্যারিঞ্চা।
সদ্যোজাতের মস্তিষ্ক, ইংরেজী ‘S’ অক্ষরের মতো মেরুদণ্ড আর একই দিকে বাঁকানো দুটি পা নিয়ে ফুটবলের জাদু দেখানো গ্যারিঞ্চা। গ্যারিঞ্চার ফুটবল খেলা ছিলো যেন শুধুমাত্র বেঁচে থাকতে। কারণ ডাক্তাররা বলের সাথে তার সংসর্গের শুরুর দিকেই গলায় একটা ‘ক্রশ’ ঝুলিয়ে দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে গ্যারিঞ্চার পক্ষে কখনও অ্যাথলেট হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু ফুটবলের হাজার বছরের ইতিহাসে তার মতো রাইট উইঙ্গার আর ছিলোনা। ১৯৫৮-এর বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন নিজের পজিশনে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। ১৯৬২-র পুরো চ্যাম্পিয়নশিপে আগাগোঁড়া সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু খেলার মাঠে বহু বছরের পদচারণার বাইরেও সেই ফুটবল ছিল শুধু ফুটবল খেলার চেয়েও বেশি কিছু। ফুটবলের ইতিহাসে আর কোনো খেলোয়াড় সম্ভবত দর্শকদের এতটা আনন্দ দিতে পারেনি।
গ্যারিঞ্চা যখন খেলতে নামতো, মাঠ হয়ে উঠতো যেন সার্কাসের একটা রিং, বল যেন একটা পোষ মানানো পশু, খেলাটা যেন আনন্দ-উৎসবের উদার আমন্ত্রণ। ছোট্ট শিশু যেমন সর্বক্ষণ নিজের পোষা জন্তুকে আগলে রাখে, গ্যারিঞ্চাও তেমনি কখনো বলকে দূরে সরতে দিতেন না। দু’জনে মিলে দারুণ সব শয়তানি ভেলকি দেখিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন। একবার সে বলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তো কখনও বল উঠে পড়ে তার কোলে। বল একবার আড়ালে লুকাতে যায়, আবার কখনও পিছু নেয় পলায়নরত গ্যারিঞ্চার। আর এসব লুকোচুরি খেলার মাঝেই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের খেলোয়াড়রা একজন আরেকজনের সাথে খায় বেদম ধাক্কা, পায়ে পা জড়িয়ে উল্টে না পড়া পর্যন্ত। গ্যারিঞ্চা তার এইসব দুষ্টু ভেলকি দেখাতেন মাঠের একদম কোণায়, ডান দিক ঘেঁষে, মাঝ মাঠ থেকে দূরে। জীর্ণ শহরতলীতে বেড়ে ওঠা গ্যারিঞ্চা মাঝ মাঠ থেকে দূরেই খেলতে পছন্দ করতেন। তার ক্লাবের নাম ছিল ‘বোতোফোগা’, মানে ‘অগ্নি প্রজ্জ্বলক’। বোতোফোগার মতোই গ্যারিঞ্চা আগুনে-পানিতে একাকার করে উন্মাদনায় জ্বালিয়ে দিতো ভক্তদের।
গ্যারিঞ্চাই সেই জন যে দূরের এক গলি থেকে ডাকতে থাকা বলের ডাকে সাড়া দিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পের জানালা ডিঙিয়ে বেড়িয়ে যেতো; বলের সেই ডাক যেন নৃত্যে আহবান করা সঙ্গীত, চুম্বনে আহবান করা রমণী। সেই গ্যারিঞ্চাই সেমিফাইনালে ৭৬ হাজার দর্শকের সামনে আরো দুই গোল দিয়ে হারায় চিলিকে, যদিও সঙ্গে কার্ডও পান, সুতরাং ফাইনালে বহিস্কৃত। ফলে ফাইনালে চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে খেলতে সেই দুর্দান্ত ব্রাজিল দলের খুব বেশি কষ্ট হয়নি। পেলের পরে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় গ্যারিঞ্চার অভাব পূরন করে, প্রথমে এক গোলে পিছিয়ে থেকেও আমারিলদো, জিটো আর ভাভার গোলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি জেতে সুন্দর ফুটবল খেলা দলটি। ব্রাজিল দ্বিতীয়বারের মতো হয় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
বিজয়ী? নাহ্, বরং অবিশ্বাস্য ভাগ্যের এক পরাজিত। গরিব ছেলেটা মাঠের বাইরের খেলায় চরমভাবে হেরে গিয়েছিলেন যে! গ্যারিঞ্চা তাই শত আনন্দ দিলেও তার মৃত্যু ছিল অনুমেয়ঃ দরিদ্র, মাতাল এবং নি:সঙ্গের। যদিও ব্রাজিল তাকে ভোলেনি, মারাকানার পুরনো স্টেডিয়ামের অ্যাওয়ে দলের ড্রেসিং রুমের নাম তিন বার বিশ্বকাপ জেতানো পেলের নামে।
আর ‘হোম’ মানে সেলেসাওদের ড্রেসিং রুমের নাম জানেন?
‘গ্যারিঞ্চা’।