রাস্তায় আরো শ’খানেক ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে ব্যাক টু দ্য ফিউচারের টাইম ট্রাভেলার ডেলোরিয়ান গাড়িতে চেপে ছুটে চলছে নায়ক। পাশ দিয়ে সাঁই করে পেরিয়ে গেলো অ্যানাইমে/মাংগার জনপ্রিয় মুখ আকিরা’র বাইক। এর মধ্যে একটা অফ-রোড ট্রাকের বিশাল চাকার নিচে দুমড়ে গেলো গোটা তিনেক গাড়ি, রেললাইন ছেড়ে আছড়ে পড়লো ট্রেন। কিন্তু থামা যাবে না। রেস চলছে তো। আর এটা বলিউড মুভি ‘রেস’ না যে নামকাওয়াস্তে হবে। এতে জিতলেই আছে অনেক অনেক … আরে ও কী! রাস্তার মাঝে যে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে জুরাসিক পার্কের অতিকায় ট্রাইরানোসোরাস এক্স!! এ কীসের মাঝে এসে পড়লাম রে বাবা। বহুকষ্টে ওটা থেকে বেঁচে পালিয়েও নিস্তার নেই। আকাশছোঁয়া বিল্ডিং ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে সেদিকেই আসছে কিং কং! কোনোমতে আবার জান বাঁচিয়ে ছুট। ওদিকে ভাঙা ফ্লাইওভারের ফাঁক গলে নিচে পড়ে গেলো ক্লাসিক ব্যাটম্যান সিরিজের ব্যাটমোবিল। হচ্ছেটা কী? কেমন অদ্ভুতুড়ে ক্রসওভার বলুন তো? কল্পনার সব সীমা তো মুছে দিয়েছেই, সব ফ্যান্টাসি আইটেম গুলিয়ে খাওয়ানোর ধান্দা। বদহজম হবে না তো? পাঠক, এটুকুতেই যদি হজমের আশংকায় ভুগে থাকেন তাহলে মুভির পুরোটায় তালে তালে আছে আরো আরো অনেক তালগোল পাকানো তালেবুল এলেম। মুভির নাম তো সুনাহি হোগা। রেডি প্লেয়ার ওয়ান।
ফ্যান্টাসি আর সুপারহিরো মুভি জঁনরার ভক্ত তো সেই ছোটোবেলা থেকেই। তবে সেই অর্থে এখনও ‘ফ্যানবয়’ হয়ে উঠতে পারিনি। তার উপর বলিহারি স্মৃতিশক্তি। কোনো একটা দৃশ্য দেখলেই চট করে ধরতে পারিনা কোন্ পপ কালচার রেফারেন্স দেয়া হয়েছে কিংবা কোন্ ‘ইস্টার এগ’ লুকিয়ে আছে সেখানে। মুভি দেখা শেষ হলে তখন ইউটুব-ই ভরসা। হিডেন ইস্টার এগ রেফারেন্স দেখার ব্যাপারটা উপভোগও করি বেশ। আমার মতো আরো যারা এই বিষয়টি উপভোগ করেন তাদের ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’ ভালো না লেগে উপায় নেই। যার গল্পই ইস্টার এগ খুঁজে বের করা নিয়ে। আর পুরো মুভিজুড়ে দু’শোর উপর পপ-কালচার রেফারেন্স ছড়িয়ে আছে। মিউজিক, মুভি, টিভি-শো, ভিডিও গেম, কমিকবুক আরো কতো কী মিলিয়ে। ওদিকে আবার নির্মাতার নাম স্টিভেন স্পিলবার্গ। যার পরিচালনায় আর প্রযোজনাতেই যে কতো অমর পপ-কালচার রেফারেন্স তৈরি হয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না।
মুভির প্রেক্ষাপট ২০৪৫ সাল। নানারকম সংকট পরবর্তী পৃথিবী। একের পর এক বিপর্যয়ের পর বিশ্ববাসী ঠিক করেছে যা যেমন আছে তেমনই রেখে দেয়া হবে। তাই শহর তো নয়, যেনো জঞ্জালের আস্তানা। ওসব নিয়ে মাথাব্যথাও নেই কারো। দেখেও দেখে না কেউ। মাথাব্যথাই বা থাকবে কেনো আর ওসব দেখবেই কী করে? প্রায় সবারই চোখের উপর চেপে বসে আছে গিয়ার-ভিআর। যা নিয়ে যায় ‘ওয়েসিস’ নামক এক ভার্চুয়াল গেমিংয়ের জগতে। যেখানে রয়েছে নানান রকম পপ-কালচার নির্ভর জগত। যার যেটা পছন্দ সে সেখানে গিয়ে নিজ নিজ ‘অ্যাভাটার’ আর টাস্ক বেছে নিয়ে সেটায় ব্যস্ত থাকে। কারো হয়তো প্রমোদভ্রমণের আগ্রহ, কারো বা গ্যালাকটিক জুয়া খেলায়, কেউ আবার ব্যাটম্যানকে সঙ্গে নিয়ে উঠে পড়ছে এভারেস্টে। কেউ খেলছে ওয়্যারক্রাফ্ট। আর সেগুলোর অভিজ্ঞতাও প্রায় বাস্তবের মতোই। ওরকম ছেলেভুলানো জগত থাকলে আর রিয়্যালিটি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কি? ভার্চুয়ালেই চুটিয়ে চলে বন্ধুত্ব, চলে কয়েন কালেকশন। তবে এর মাঝেও আছে অনেককিছু পাবার একটা মেগা ইভেন্ট। ওয়েসিস-এর প্রবক্তা জেমস হ্যালিডে মারা যাবার আগে পৃথিবীজোড়া গেমারদের জন্য দিয়ে গেছেন এই ‘ওয়েসিস’-এর মালিকানা পাবার এক সুবর্ণ সুযোগ। চকলেট ফ্যাক্টরির উইলি ওংকা’র মতোই তার চরিত্র। ধনী, খেয়ালি, বর্ণিল। হ্যালিডের চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য ওয়েসিস-এ তিনটি টাস্কে অংশ নিয়ে সংগ্রহ করতে হবে তিনটি চাবি। যার প্রথম টাস্ক প্রথম প্যারায় উল্লেখ করা রেস। তিন চাবি পেলেই দেখা মিলবে ইস্টার এগের। আর পপ-কালচারের মহাভক্ত হ্যালিডের লুকানো চাবির ক্লু পেতে তালাশ করতে হবে তার পছন্দের পপ-কালচার রেফারেন্সে। কোটি কোটি গেমার দিনরাত খেলেও হদিস পায়না চাবির। তেমনই একজন গেমার গল্পের নায়ক সতেরো বছরের ওয়েড ওয়াটস, ওয়েসিসে যার অ্যাভাটারের নাম ‘পারজিভাল’। আর গল্পের ভিলেন কে? তিনি নোলান সরেন্টো নামের এক ভদ্রলোক। তিনি ইনোভেটিভ অনলাইন ইন্ডাস্ট্রিজ (আইওআই) নামক সারাবিশ্বের ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়া প্রতিষ্ঠানের হেড অব অপারেশনস। ওয়েসিস-এর মালিকানা পাবার জন্য তিনি নিয়োগ দিয়েছেন হাজার হাজার লোককে। তাদের কাজ হ্যালিডের পছন্দের পপ-কালচার গবেষণা করে সেখান থেকে ক্লু বের করা। এবং এরপর ওয়েসিসে ঢুকে চাবি খোঁজার মিশনে নেমে পড়া। তবে আইওআই যদি ওয়েসিস-এর মালিকানা পেয়ে যায় তবে পৃথিবীবাসীর ঘোর বিপদ। কী বিপদ তা বললে স্পয়লার হয়ে যেতে পারে। ওয়েসিস-এ পারজিভাল আর তার বন্ধু ‘এইচ’, আরটেমিস, ডাইটো আর শোটো মিলে কীভাবে মোকাবেলা করলো চ্যালেঞ্জগুলোর তারই মজার, উপভোগ্য, রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’।
আশির দশককে বলা হয় পপ-কালচারের স্বর্ণযুগ। আর্নেস্ট ক্লাইনের বেস্টসেলার সায়েন্স ফিকশনের উপর নির্ভর করে তৈরি হওয়া এই মুভি সেই স্বর্ণযুগকে ট্রিবিউট দেয়ার উদ্দেশ্যে একটা শব্দ করে ঠোকা স্যালুট। মাঝে একটু ঝুলে গিয়েছিলো। আর ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে বলে ওদিকে ২০৪৫ সালের বাস্তব পৃথিবীর দৃশ্যচিত্র কিছুটা কম। ব্যক্তিগত মত বলছে যে রেডি প্লেয়ার ওয়ান-এর মাঝে আছে একটা ‘কাল্ট মুভি’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। হবে কি হবে না সেটা ভবিষ্যৎ পৃথিবী বলবে। আর যদি না-ও হয়, একই মুভিতে হার্লে কুইন আর চাইল্ডস প্লে-র চাকি কে দেখতে পাবার বিরল অভিজ্ঞতার জন্যেও দর্শক একে মনে রাখতে বাধ্য।