‘দেবী’ টি-ব্যাগে
ঝাঁকি আবেগে

দই-মিষ্টি যারা বানান তাদের পেশাগত নাম ‘ময়রা’। স্থানভেদে তাদের ‘মিষ্টি তৈরির কারিগর’ও বলা হয়। আমাদের দেশে বংশপরম্পরায় মিষ্টি তৈরির কাজটা একসময় একচেটিয়াভাবে ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী ‘ঘোষ’ সম্প্রদায়ের এখতিয়ারে। যদিও সময় বদলেছে। মুসলিমরাও মিষ্টি তৈরিতে হাত পাকিয়েছে। মুসলিম মালিকানাধীন কিংবা মুসলিম কারিগরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিখ্যাত সব মিষ্টির দোকানই এর প্রমাণ। তারপরও এখনো দেশে বিভিন্নজনের নামে ‘মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’, অমুক অ্যান্ড সন্স, তমুক গ্র্যান্ডসন্স নামে মিষ্টির দোকান দেখা যায়। মুসলিম মালিকানার দোকানেও কাজ করছেন হিন্দু কারিগরেরা। নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে (এমনকী ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও) তাদের কাছ থেকে মিষ্টি নিয়ে মিষ্টিমুখ করেই জ’মে ওঠে আমাদের আয়োজন। শুধু মিষ্টির কথা না হয় বাদ দেই। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, পুরান ঢাকার। জানেন তো এই অঞ্চলের মানুষ কতোটা ধর্মপরায়ণ। তো রোজার মাসে এই অঞ্চলের মানুষের ইফতারের নিয়মিত একটি আইটেম- ঘোল বা মাঠা। এই মাঠা কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই বিক্রি হয় অস্থায়ী সব দোকান থেকে। তো লালবাগ এলাকায় একটি ছোট্ট বন্ধকী দোকান আছে। দেব-দেবীর মূর্তি আর ছবিওয়ালা ওই দোকানের সামনে থেকে প্রতি রোজায় প্রতিদিন শ’খানেক বা তারও বেশি ধর্মপরায়ণ রোজাদার মুসলিম ইফতারের প্রয়োজনীয় ও পছন্দসই মাঠা কিনতে দ্বিধা করেন না। তাতে ধর্ম নিয়ে কারো আবেগ নড়বড়ে হয়ে যেতে দেখা যায়নি এখনও। কারণটা স্পষ্ট। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হাতে বানানো হলেও পূজা-অর্চণায় উৎসর্গ করার জন্য নয়, খাবার আইটেমটি বানানো হয়েছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে। যেকোনো কাজেই এই উদ্দেশ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ সেটাকে বুঝতে পারাও।

প্রয়াত ঔপন্যাসিক ও নির্মাতা শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ উপন্যাস অবলম্বনে জয়া আহসানের অভিনয় ও প্রযোজনায় এবং অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় একই নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, সরকারি অনুদানে। শিগগিরই মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এটি পুরোনো খবর। তেমনই পুরোনো খবর এ চলচ্চিত্র নির্মানের অনুমতিপ্রাপ্তি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের দুই পরিবারের মধ্যে আপত্তি-অনাপত্তি বিষয়ক ঘটনা। ওসব মিটমাট হয়ে চলচ্চিত্রটির আলোর মুখ দেখতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার খবর আমাদের সকলের জন্যই আনন্দের। বড় পর্দায় মিসির আলীকে নিয়ে তৈরি প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য ‘দেবী’ কতোটা যুক্তিযুক্ত কিংবা জয়া আহসান চরিত্রটির জন্য কতোটা মানানসই তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে মতবিনিময়। একইসাথে চলছে সেটার প্রচার-প্রচারণাও। আর তারই অংশ হিসেবে গেল সপ্তাহে ফেসবুক দুনিয়ায় ঘটে গেছে ছোটোখাটো একটা সাইমুম থুক্কু ঝড়। তার কারণ- উদ্দেশ্য বুঝতে না পারা।

ফেসবুকে আমাদের অনেকেই চিলের ফলোয়ার। কান নিয়ে গেছে বলে প্রায়ই চিলের পেছনে ছোটেন। দেবী-র প্রচারণায় একটি চা ব্র্যান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘টি-ব্যাগ স্টোরিজ’ নামের একটি ফেসবুক পেইজের উদ্যোগে টি-ব্যাগের উপর ‘দেবী’ সিনেমার পোস্টারটি এঁকে অভিনব ওয়ালপোস্ট শেয়ার করা হয় নামকরা চা ব্র্যান্ডটির পেইজ থেকে।

এই সেই ছবি!

ব্যস্, রোজার মাসে ওই টি-ব্যাগ আর ‘দেবী আসছে’ লেখা পোস্ট দেখে কতিপয় আবেগী উত্তেজিতর মাঝে আলোড়ন জেগে উঠলো। তারা ধুয়ে দিলেন এই বিজ্ঞাপনী কর্মকাণ্ডকে। এবং ধোলাইয়ে ব্যস্ত কমেন্টপ্রদানকারীদের কেউই আসলে এটি যে একটি সিনেমার প্রচারণা, ‘দেবী’ যে সিনেমাটির নাম, টি-ব্যাগটি যে শুধুই একটি আর্টওয়ার্ক এবং এটি আসলে এই ছবি দিয়ে চা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি বাজারজাত করতে যাচ্ছে না; এসব বোঝার ধারেকাছ দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। পোস্ট দেখেই অনেকের অনুভূতি তীব্র আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এরপর আরো অনেকে এই ন্যাক্কারজনক কাজের জন্য পণ্যটি বর্জনের ডাক দেন।

অনুভূতির অসহনীয় এক তীব্রতা

জ্ঞানীরা জ্ঞান দেবেন। দিতেই পারেন। ব্যক্তিগত মতামত। আমার ‘বস্’ একবার বলেছিলেন, ফেসবুক আসার পর বোঝা গেছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই তাবৎ বিষয়ে একটা ‘বক্তব্য’ আছে। সেই তত্ত্ব মেনে জ্ঞানীরা বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো কমেন্টের রিপ্লাইয়ে তাদের বক্তব্যে সমর্থকের সংখ্যা। সে সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে তীব্র ঝাঁকি খাওয়াদের বক্তব্যের মূল কথা এটাই- মুসলিমপ্রধান দেশে ‘দেবী’র ছবি ও নাম দিয়ে টি-ব্যাগ ছাপানো গর্হিত একটি কাজ। অতি উৎসাহী কেউ কেউ তো একে তাদের ‘জন্নো’ একে হারাম ‘পন্নো’ ঘোষণা করলেন।

কি হইতে কি হইয়া গেল, ইয়োর অনার!

শেষমেশ সিনেমাটির পৃষ্ঠপোষক চা ব্র্যান্ড ইস্পাহানি বাধ্য হয় প্রতিটি কমেন্টের উত্তরে দুঃখ প্রকাশের এবং পুরো বিষয়টির প্রেক্ষাপট বর্ণনার। তাতেও খুব একটা লাভ হয়েছে- সেটা বলা যাচ্ছে না। অণুভূতিপ্রবণ দেশ তো! তবে আশার বিষয় ওইসব নড়বড়ে আবেগী বয়ানের পাশে ইতিবাচক কমেন্টও প্রচুর। তারা টি-ব্যাগে আর্টওয়ার্কের প্রশংসা যেমন করছেন, তেমনই চায়ের প্রতিষ্ঠানটিকে অনুরোধ জানিয়েছেন বেশি বুঝদার ওই ব্যক্তিদের কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে সময় অপচয় না করার জন্যেও। যারা হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ তো পড়েননি-ই, এমনকি বইটি সম্পর্কে কিংবা এই পোস্টটির পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে অনর্থক অনুভূতিতে আঘাত পেয়েছেন তাদের জন্য আয়োডিনযুক্ত বিশেষ চা উৎপাদনেরও পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। তারচে’ বড় কথা, কোন্ পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে এতো হাউকাউ? ওই পণ্যটাও কিন্তু কোনো ধর্মীয় পুণ্যভূমি থেকে আসেনি। ফাও খাইয়ে চা-পানের চল আমাদের মাঝে তৈরি করে দিয়ে গেছে ব্রিটিশরা। যে চায়ের কোম্পানিকে বর্জন করছেন, সেই চা-পান এক অর্থে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ব্রিটিশদের অনুসরণ নয় কী ইয়োর অনার? হাউকাউটা হচ্ছেও কোন প্লাটফর্মে দেখুন! ইহুদী-নাসারাদের তৈরি করা জায়গা ফেসবুকে! এমনকি যে ভাষায় আবেগ-অনুভূতির লড়াই চালাচ্ছেন সেটাও কি তাদের মতে ধর্মসম্মত? এই ভাষা প্রতিদিন ব্যবহার করতে গিয়েও আবেগ নড়বড়ে হয়ে যায় না তো? স্ট্রাগল তাহলে প্রতিদিনের। নয় কী?? কি মনে হয়?