একটা সাদা কবুতর ইদানিং খুব ঘুরছে। উড়ে উড়ে ঘুরছে ফেসবুক হোমফিডে। এর ওর প্রোফাইলে বসে। তা দেখে দেখে কেউ প্রশ্রয় দিলেই হয়েছে। টুক করে পেরিয়ে যাবে ব্যক্তিগত বেড়াজাল। তারপর ওই আদিকালের মতো বার্তা আনা-নেয়ার কাজটা করার জন্য বসে থাকবে। কেউ তাকে উড়ো চিঠি ধরিয়ে দিলে পৌঁছে দেবে প্রাপক বরাবর। কিন্তু শুধু বার্তাই পৌঁছে দেবে, প্রেরকের নামটা নয়। কবুতরের ছবিওলা কারো কারো কাছে স্টুপিড ওই জিনিসটা আসলে একটা অ্যাপ। অভিমান, রাগ, অনুরাগ, অনুরক্তি, বিরক্তি, খেদোক্তির স্বীকারোক্তির অ্যাপ। নাম- ‘স্টুলিশ’। যিনি এই সাদা পায়রাকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন তিনি সুযোগ দিলে তার দিকে বাক্যবাণ ছুড়ে আপনি ইচ্ছেমতো ঘায়েল করতে পারবেন। কিন্তু ঘায়েল হবার আগে বা পরে কোন্ তীরন্দাজ ওই তীর ছুড়ে সর্বনাশটা করলো তা তীরন্দাজ না চাইলে ভিকটিমের কখনোই জানা হবে না। তাতে বয়েই গেছে ইন্টারনেট জগতের বাসিন্দাদের। যাদেরকে আদর করে ডাকা হয় ‘নেটিজেন’। তারা বেশ মজা পাচ্ছেন অচেনা অজানা মানুষের কাছ থেকে আসা বাক্যবাণে ঘায়েল হয়ে। কেমন সেধে সেধে বিধিয়েছি তীর টাইপ। নাহলে কি বেনামি ‘গোপন’ ম্যাসেজের ছবি গদগদ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবেন?
গত সেপ্টেম্বরের দিকে এমন আরেকটি অ্যাপ ‘সারাহাহ্’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। পরে অবশ্য সারাহাহ্-র মাধ্যমে সাইবার বুলিং প্রশ্রয় পাচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছিলো। এমনকি এর মাধ্যমে দুই পক্ষের ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য পাচার হয়ে যাবার কথাও শোনা যায়। সারাহাহ্’র একই চরিত্রের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় ‘স্টুলিশ’। ছেয়ে গেছে সে-ও। জানিয়ে দিচ্ছে সিক্রেট অ্যাডমায়ারের মনের কথা। তবে যে অনুরাগীর নামটাই জানলাম না তাকে নিয়ে কেনো মাতামাতি, কীসের লাগি অলীক সুখ-জ্ঞাপন তাই নিয়ে একশ্রেণির ফেসবুক দর্শকও কিন্তু সোচ্চার। বেনামি পত্র কাণ্ডের জেরে তাদের টাইমলাইনের স্টুলিশ-জনিত আগাছায় তারা বিরক্ত। দাবি জানায় তার সমূলে উৎপাটনের।
আজকাল যা-ই ভাইরাল হয়, তা বেশি একটা ডালপালা ছড়ায় না। তাই স্টুলিশ-এর বিস্তার নিয়ে মনের শান্তি নষ্ট করার দরকার নেই। আর সাদা পায়রা কিসের প্রতীক জানেন তো? শান্তির। এই বেনামি বার্তাবাহক সাদা পায়রাও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। কেউ হয়তো বহুদিন ধরে চায় তার ক্রাশকে নিজের মনের অ-বলা কথা ব্যক্ত করতে। কিন্তু অনেক সংকোচ। কি না কি মনে করে। এই সংকোচ কাটিয়ে মনে বল সঞ্চার করে অ-বলাকে বলে দিতে কেবল স্টুলিশ দিয়েই পারবে। তার বার্তা যার কাছে পৌঁছুলো সে হয়তো তার নামটা অনুমানও করতে পারলো না। তাতে কি? প্রেরকের উতলা মন শান্ত তো হলো। আবার ধরুন কাউকে একদম দু’চোখে দেখতে পারেন না। তাকে দেখলেই দু’টো কথা শুনিয়ে দিতে মন চায়। কিন্তু সমাজ-সভ্যতার দোহাই দিয়ে সে ইচ্ছেপূরণের সুযোগ পান না। সমস্যা নেই। স্টুলিশ তো আছেই। প্রাপককে যা ইচ্ছে তা শুনিয়ে মন হালকা করুন। যাকে বললেন সে-ও জানলো। কিন্তু ঝগড়াঝাটির সুযোগ নেই। দুই দিকেই শান্তি আর শান্তি। সাপ ক্ষতবিক্ষত, আবার লাঠিও অক্ষত। এমন শান্তির বার্তাবাহক অ্যাপটিকে বন্ধ করতে চান? আপনি তো হিটলারের চেয়েও খারাপ। হিটলারের আমলে যদি স্টুলিশ থাকতো কী হতো একবার ভাবুন তো। তার মোবাইলে ঠিক পৌঁছে যেতো নানাপ্রান্তের নানা মানুষের পাঠানো বিষোদগার, কিংবা হেদায়েতের বাণী। থাকতো ভালো হয়ে যাবার হুমকি, কিংবা দ্রুত রোগমুক্তির আশাবাদ। কিংবা থাকতে পারতো জর্মন কোনো ললনার প্রেমপতনের (ক্রাশ) কাব্য। ওসব দেখে দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে দ্বিতীয়বার ভাবতেন না বলতে চান? আরেকটু এগিয়ে যাই না। রোমিওর স্টুলিশ-এ যদি থাকতো জুলিয়েটের আগেভাগে পাঠানো বেনামি বার্তা- ‘যতো যাই হোক, বেঁচে রইতে ভুলো না’, তবে কি আর রোমিও আত্মহননের পথ বেছে নিতো? হ্যাঁ, হয়তো রোমিওর মনে অন্য লাড্ডু ফুটতো, তাতে কী! গল্পটা তো অন্তত চেঞ্জ হতো। এই করে করে স্টুলিশ পুরো বিশ্বে কায়েম করতে পারতো শান্তির রাজত্ব।
এমনিতেই ফেসবুক কিন্তু আর আগের মতো নেই। কিছু কথা হেথায় আর থাকে না গুপোন। তাই রাত বাড়লে ফোনটা গৃহকর্মীর হাতে গেলে স্ক্রিনশট কেলেংকারি ঘটতেই পারে। আবার ফাঁস হতেই পারে সারাহা বা স্টুলিশ-এ আদানপ্রদান হওয়া সব মেসেজ। হতেই পারে। এতে ভয় পাবেন না জগতের স্টুলিশ প্রেরকগণ। আপনি মনের সত্যটা প্রকাশ করেছেন মাত্র। আর প্রাপকদের বলছি- শুধু প্রশংসা নয়, নেতিবাচক সমালোচনাকেও গ্রহণ করতে শিখুন। উদার হোন। দেখবেন সর্বত্র শান্তি আর শান্তির সফেদ পায়রা। ডানা মেলে উড়ছে পত্ পত্।
তাই স্টুলিশ বন্ধ করে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ লঙ্ঘিত করবেন না ইয়োর অনার! স্টুলিশ চলুক। আর যদি স্টুলিশ-এর বাড়াবাড়িতে খুব বিরক্ত হয়েই থাকেন জনাব ফেসবুক ইউজার, স্টুলিশ-ধারীদের বকবেন না। ওদের দূরে ঠেলবেন না। শুধু ছোট্ট করে ট্যাপ করে অ্যাপটাকে হাইড করে দিন।