হাস্তা লা ভিস্তা, এবি

স্কুল ইউনিফর্ম পরেই জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল, রাগবি, গলফ, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন অহরহ খেলে বেড়াতেন বাবার উৎসাহে। তবে বাড়ির আঙ্গিনায় ফিরে তার পছন্দের খেলা ছিলো ক্রিকেট। ঐ বাড়ির খেলা ক্রিকেটেই শেষমেশ মজলেন এবি, এবি ডি ভিলিয়ার্স। স্কিল আর প্যাশনের দুরন্ত যুগলবন্দি সোনালী চুলের শান্ত ছেলেটাকে মাত্র বিশ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে গেলো। ছুঁড়ে নিয়ে ফেললো ইংল্যান্ড- অস্ট্রেলিয়ার বাঘা বাঘা সব পেসারদের বোলিং তোপের মুখে।

শুরুতেই মারকাটারি ব্যাটিং দিয়ে নজর কেড়ে নিলেন সবার। ব্রেট লি-অ্যান্ডারসনদের তুলোধুনো করে ছেড়েছেন নজরকাড়া একেকটা শটে। প্রথম টেস্টেও ব্যাটসম্যান হিসেবে দারুণ শুরুর পরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পরের টেস্টেই ব্যাট হাতে নামলেন লেট অর্ডারে,৭ নম্বরে। নিশ্চিত হারতে বসা ম্যাচে বুক চিতিয়ে লড়াই করে খেলেছিলেন ম্যাচ বাঁচানো অর্ধশত রানের এক ইনিংস। এরপরের গল্প যেন ছাড়িয়ে যায় রূপকথাকে। সে গল্পের নায়ক ঝড় তুলেছেন সমগ্র বিশ্বের কোটি ক্রিকেট ভক্তের হৃদয়ে। তকমা পেয়েছেন সবচেয়ে ‘কমপ্লিট’ খেলোয়াড়ের। কেউ বলেছেন ভিনগ্রহের খেলোয়াড়। ক্রিকেট ধারাভাষ্যকাররা নাম দিয়েছিলেন মিস্টার ৩৬০। অনায়াসে বৃত্তাকার মাঠের যেকোনো দিকেই যে ছক্কা হাকাতে পটু ছিলেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙ্গে ফেলেন বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রেকর্ডও। টেস্টে আগে কিপিং করলেও সীমিত ওভারের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে কিংবদন্তী প্রোটিয়া উইকেট রক্ষক মার্ক বাউচারের অনুপস্থিতিই তার হাতে গ্লাভস ধরিয়ে দেয় টিম ম্যানেজমেন্ট। আর সে ম্যাচেই কিপিং পজিশন থেকে চিতার গতিতে দৌড়ে থার্ডম্যানে গিয়ে ক্যাচ লুফে নিয়ে জানান দেন যে উইকেট-কিপার হিসেবেও তিনি কতটা ‘স্পেশাল’।

স্প্রিংবক জার্সিতে আর দেখা মিলবে না এবির

এরপরে এসেছে খারাপ সময়ও। ভক্তদের প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে থাকলেও ২০০৭ সালের বিশকাপে ব্যাট হাতে দলকে তেমন কিছুই দিতে পারেননি। সেজন্য অনেক সমালোচনা সয়েছেন। আর দু’দশটা সাউথ আফ্রিকানের মতো বড় আসরে আসলেই এবি ম্যাজিক হারিয়ে যায়।

সেই সমালোচনার জবাবে ফুঁসে উঠতেও বেশি সময় নেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টানা ভালো খেলতে থাকা এবির তুমুল ব্যাটিংয়ে জমে ওঠে আইপিএল। আসরের ভয়ংকরতম ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন বোলারদের দুঃস্বপ্ন।

২০১১ বিশ্বকাপে জোড়া সেঞ্চুরিও করে কোয়ার্টার ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় ‘চোকার্সদের’। কিন্তু এবি থামেননি। বরং দুর্দান্ত প্রতাপে এগিয়ে গেছেন। কখনও অনিন্দ্যসুন্দর ফিল্ডিং, কখনও ব্যাটে বুনো ঝড় তুলে আবার কখনও টেস্টের ৫ম দিনে নিজের মারকাটারি মেজাজ পকেটে লুকিয়ে রেখে দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতে ক্রিজে অভেদ্য রক্ষণদুর্গ হয়ে নিশ্চিত হারতে বসা ম্যাচ বাঁচিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

এরপরে এসেছে ২০১৫ বিশ্বকাপ। ৯৬ গড় আর ১৪৪ স্ট্রাইক রেটে ৪৮২ রান তুলেছিলেন ঐ বিশ্বকাপে। নিজ কাঁধে সওয়ার করে দলকে নিয়ে গেছেন সেমিফাইনালেও। আরও একবার রূপকথার দ্বারপ্রান্তে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে সেই কিউই বোলারদের সুনিপুণ বোলিং-ব্যাটিংয়ে। ম্যাচ হেরে সবুজ মাঠে নিস্তেজ হয়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন, ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক ধ্বংসযজ্ঞের নায়ক। এত কাছে তবু এত দূরে। হল না সেবারেও।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২০ হাজার রান, ভক্তদের ভালোবাসার তুলনায় তেমন কিছুই না। এখনো ভারতের বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইশ গজের পিচে তিনি ব্যাট হাতে দাঁড়ালে ৫০ হাজার দর্শক তার নাম ধরে চিৎকার করে, পুরো স্টেডিয়ামটাকেই গম গম করে কাঁপে তোলে।

এবিকে কমেন্টেটররা বলতেন মিস্টার ৩৬০

২০১৮ সালের ২৩ মে সেই আবেগপ্রবণ লোকটাই হঠাৎ জানিয়ে দিলেন, তিনি আর খেলবেন না। দেশের জার্সি গায়ে আর কিছুই খেলবেন না। তিনি ক্লান্ত। আর এই অকস্মাৎ ক্লান্তিই হতবাক করে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে তার অগণিত ভক্তদের। আগামী বছরই যে অপেক্ষা করছে আরও একটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ভক্তরাও বলছে, ‘ইটস টু আর্লি।’

যদিও পেছনপানে ফিরলে দেখা যাবে, অল্পসময়ে ক্রিকেটকেও কম দেননি তিনি। ওয়ানডেতে দ্রুততম ৫০, ১০০ এবং ১৫০ রানের মালিক মাঠের এই নিপাট ভদ্রলোক/ ঠাণ্ডা মাথার খুনি, যাকে ভালোবেসেছেন ভক্তরা। সাউথ আফ্রিকার জার্সিটা পরে শতরান হাঁকিয়ে আর ব্যাট উঁচিয়ে ধরে হাসবেন না এবি। আর দেখা যাবে না পিচের উপর বসে পড়ে বাঘা বাঘা পেস বোলারদের বলগুলো মাথার পেছনে ঘুরিয়ে আছড়ে ফেলছেন মাঠের বাইরে। সবুজ জার্সিতে পয়েন্টে দাঁড়ানো অভেদ্য দেয়ালটাকে আর দেখা যাবে না।

আদ্যন্ত ভদ্রলোকসুলভ খেলোয়াড় এবির ভক্তকুল তার অবসরে বিস্মিত, আহত!

ম্যাচ পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতায় সবসময় দেখা গেছে, বিপক্ষে খেলোয়াড়দের প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মাঠে, প্রেস কনফারেন্সে। ম্যাচের পর ম্যাচে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও কখনো অহংকার ছুঁয়ে যায়নি মানুষটাকে। অবুঝ ভক্তহৃদয় তাই হয়ত ভাবছে, প্রতিজ্ঞা ভেঙে তিনি ফিরবেন। কেননা এরকম একজন ক্রিকেটার না থাকাই একটা বিশ্বকাপকে নির্জীব করে দিতে পারে। বিশ্বকাপতো প্রতি চার বছর পর পর নানান রূপে আসে, আসবে কিন্তু আব্রাহাম ডি ভিলিয়ার্সরা যে বছর বছর আসবেন না সে তো স্ট্যাট দেখলেই বোঝা যায়।