সান্তা’র পান্তা

বোশেখ মাসের গরমের সাথে লাল-সাদা উলেন কোটের মিক্সই তো মিস্ ম্যাচ! যাপিত জীবনে আমরা অহরহ অনেক আবোল-তাবোল দেখছি। বছরের শুরুতে এমন আরও একটা হাঁসজারু দেখা হয়ে গেল। প্রথম দিন যা করা হয় তার রিপিট প্রতি দিন হয়না বলেই রক্ষে! নাহলে প্রতি দিন আকাশপথে মিস টাইমিং হতো আর এমন প্রতি দিন সান্তা ক্লজের মতো উটকো ঝামেলা মাথায় পড়তো।

হ্যাঁ, সান্তা ক্লজ। অন্তত সামনে বসে থাকা ভদ্রলোক নিজেকে তাই-ই দাবি করে চলেছেন। অনেকক্ষণ ধরে। ভদ্রলোক পহেলা বৈশাখে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর যাবার রাস্তার মাঝামাঝি এক জায়গায় ‘পান্তা’র দোকান দিয়ে বসেছেন। যেটায় হাতে লিখে কাগজ সাঁটিয়েছেন “সান্তা’র পান্তা”। সারাদিন নানান টেক্সট-কপি নিয়ে যার কারবার তার চোখে ওই লেখাটা পড়বে না তা হয় না। কাঠফাটা রোদে সস্তার সানগ্লাস চোখে হাঁটতে হাঁটতে জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম। একবার মনে হলো ভুল ঠাহর করলাম কি না। তাই ফিরে এসে সানগ্লাস তুলে আবার দেখলাম, শান্তা লিখতে যেয়ে হয়তো সান্তা লিখে ফেলেছে ভুলে। তাই ঘুরিয়ে দোকানের তদারকিতে ব্যস্ত মাঝবয়সী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এখানে যে নামটা লেখা সেটা আপনার স্ত্রী না কন্যার?

উত্তর আসলো, দাদা, এটা আমার নিজের নাম।

ভদ্রলোকের কথার টান থেকে মনে হয় তিনি এখানকার কেউ নন। শিওর হতে তাই কথা চালিয়ে যাই।

– আপনার নামই শান্তা?

– জ্বী। তবে উচ্চারণ শান্তা না, সান্তা।

মাটির শানকি, আই মিন সানকিতে একজন কাস্টমারকে পান্তা সার্ভ করতে করতে জানালেন তিনি।

– পুরো নাম সান্তা ক্লজ।

– সান্তা ক্লজ? মানে ওই বড়দিনের বুড়ো? বল্গা হরিণের ঠেলা থুক্কু স্লেজগাড়িতে করে গিফট বিলি করে বেড়ায় যে তার সাথে মিলিয়ে নাম।

আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক গলাটা নামিয়ে কানের কাছাকাছি এলেন।

– আজ্ঞে, আমিই সেই অধম। আমি ডিসেম্বর মাসে ওই কাজ করে বেড়াই। এখন সময়-কালের ছোট্ট একটা হিসেবের গন্ডগোলে যান্ত্রিক গোলযোগ বাধিয়ে অসময়ে এ তল্লাটে চলে আসা।

ভাগ্যিস ‘পিকে’ দেখা ছিলো। নাহলে লোকটার গল্প সত্যি বলে তৎক্ষণাৎ বিশ্বাস করে নিতাম। ‘পিকে’ জানিয়েছে ওসব শুধু মুভিতেই হয়।

– তা ঠিক কখন বুঝলেন সময়-কালে বিরাট গন্ডগোল ঘটে গেছে?

এ কথায় হাত মুছে নিয়ে পকেট থেকে একটা ফোন বের করলেন। এমন ঢাউস ফোন সচরাচর দেখা যায় না ঠিক। তবে ইস্টার্ন প্লাজার পেছনের দিকের দোকানগুলোয় খুঁজলে ঠিকই পাওয়া যাবে।

– আরে এই যে দেখেন না, স্মার্টফোন না কি ছাই! এই অ্যাপ্, সেই অ্যাপ! অ্যাপ তো না, একেকটা হ্যাপা!

– বাহ্! সান্তা ক্লজ আবার স্মার্টফোনও চালায়। ভালোই গুলতানি তো।

নিজেকে সান্তা ক্লজ দাবি করা ভদ্রলোকের মুখে এবার হাসি। জিজ্ঞেস করলাম-

– হাসলেন কেনো?

– এই বাংলাদেশে বসে ভিনদেশির গুলতানি নিয়ে কথা বলা একটু ইয়ে না? যাকগে বাদ দিন ওসব। ওপরে ওই স্টিভটা আসার পর থেকেই ভেজালের শুরু। সবাইকেই নাকি আপ-টু-ডেট থাকতে হবে।

– কোন স্টিভ?

– কে আবার? জবস। আমি বুড়ো মানুষ। কোথায় মুঠোফুন মেরে শুধু কল করবো আর দুই একটা মেরি ক্রিসমাস লেখা টেক্সট পাঠাবো…। বললাম, দিলে আমায় অ্যান্ড্রয়েড দাও। কিন্তু উনি দিলদরিয়া। দিলেন আইফোন।

এ কথা শোনার পর ঢাউস ফোনটার উল্টোদিক খেয়াল করার চেষ্টা করলাম। তাজ্জব ব্যাপার, সেটার ব্যাক কভারে ঠিকই একটা ‘অ্যাপল’ লোগো শোভা পাচ্ছে। ভদ্রলোক কথা বলে যাচ্ছেন।

– আইওএস-এর ঠ্যালায় পড়ে গিয়ে বার বার খালি ‘এসওএস’ মাথায় ঘোরে। যা বলছিলাম, ওই সব আজব গজব অ্যাপসের পাল্লায় পড়ে কখন যে ‘দেবস বুক’-এ অটো চেক-ইন স্ট্যাটাস পড়ে গেছে কে জানে। সেটা দেখেই নগদে নারদ মুনির কমেন্ট।

– নারদমুনি??

– দাদা এমন অবাক হচ্ছেন কেনো বলুন তো? এইখানেই না যত ক্লাস, রেসের বেড়া। ওপরতলায় তো পুরো গণরুম। এই নিচের বারান্দায় মোজেস হাওয়া খাচ্ছে তো তার সামনের লনেই মুগুর ভাজছে অর্জুন। ওহ্ না, ওটা তো ভীম। বয়স হয়েছে, না চিনতে পারি, না মনে রাখতে পারি। ওই ভীম একটা পাজির পা ঝাড়া। প্রত্যেক দিন হারকিউলিসের পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করে। বোঝেনই তো এ দু’য়ের লড়াইয়ে কী হতে পারে। এদিকে আমি সব সইতে পারি, কিন্তু ভাত ঘুমের ডিস্টার্ব নো বরদাশত। দিলাম জিউসের কাছে বিচার। রুল জারি হলো। তারপর চিত্রগুপ্ত নানান নথি ঘেঁটে বলে “স্পর্শকাতর ইস্যু- হাইলি সেনসিটিভ”। আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার আশঙ্কা।

– এই না বললেন ওপরে সব ঠান্ডা? সবাই মিলমিশ…

– কিছু প্রটোকল তো মেনে চলতেই হয় গো দাদা। আচ্ছা কই ছিলাম? ওহ্ তো ওই নারদের খেয়েদেয়ে কাজ তেমন একটা নেই। সারা দিন দেবস বুকে অনলাইন। আর একটু পর ‘নারায়ণ নারায়ণ’ লেখা স্ট্যাটাস আপডেট। গত তিন সাড়ে তিন হাজার বছরে নতুন কোনো স্ট্যাটাস লিখতে দেখলাম না। আমার চেক-ইনে নারদই ফার্স্ট কমেন্ট দিলো- “ডুড্, পাদুকা সাম্ভালকে!”

– আপনার গাঁজাখুরি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বোশেখ মাসের শুরুর দিনের ভরদুপুরে এমন আষাঢ়ে গল্প …

– আপনাকে তো আর সেধে সেধে গল্প বলতে বসিনি। আপনি জানতে চাইলেন তাই বলছি।

ইদানিং গল্পের খোঁজে হন্যে হয়ে থাকি। পোটেনশিয়াল একটা গল্পের গায়ে পানি ঢেলে দিতে পারি না। পান্তাবিক্রেতা সান্তাকে চটানো ঠিক হবে না। তাই তাকে ঠান্ডা করলাম।

– আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বলতে থাকুন।

– ততক্ষণে দুর্গা ‘সান্তা দাদু অ্যাট মাই নেটিভ ল্যান্ড’ লিখে হ্যাশট্যাগ মেরে সেটা শেয়ারও করে ফেলেছে। গৌতমের মতো দেখতে কে যেনো সেটায় লাইক দিয়ে একটা লাফিং বুদ্ধার ইমোজি মেরেছে। পাবলিক পোস্ট তো! কে কোথা দিয়ে কমেন্ট করে বোঝা মুশকিল। আবার ওদিকে অনেকের কোশ্চেন মার্ক লেখা কমেন্টও পড়েছে। লাইকের লিস্ট খুলে দেখছিলাম ঊর্বশী-মেনকারা কেউ রিঅ্যাক্ট করলো কি না। তো একটু পর ক্রমাগত নোটিফিকেশনের জ্বালায় একটু একটু ঘামতে শুরু করার পর চারপাশে তাকিয়ে দেখি আসলেই উলের কোট খোলার মতো জায়গায় এসে হাজির হয়েছি। এমনই শক্তিশালী ফোন। যেখানে চেক-ইন পড়বে, আপনাকে সেখানেই নিয়ে হাজির করবে। আগে রিঅ্যাকশন, পরে অ্যাকশন আর কি। এরপর ধাতস্থ হয়ে ফোনে ‘ভূগোল ম্যাপস’ গুতিয়ে দেখলাম এটা বাঙ্গাল মুলুক। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি ঠিকই পাদুকা জোড়া গন।

– আর স্লেজ গাড়ি?

– রাত দেড়টার সময় স্লেজ গাড়ি অক্ষত থাকার গ্যারান্টি তো হ্যারি হুডিনিও দিতে পারতো না।

বাপরে! বুড়ো হ্যারি হুডিনিকেও চেনে। ইন্টারেস্টিং।

– গাড়ি গেলো, বল্গা হরিণগুলো তো নেই-ই, গিফটও লাপাত্তা। যে স্ট্রাইক রেটে জিনিসপত্র উধাও হল, ওই স্পিডে তো গিফট ডেলিভারির গ্যারান্টিও দিতে পারি না।

– না বলে, না জানিয়ে রাত দু’টোয় হাজির হয়ে আপনি কী লাল গালিচা সংবর্ধনা আশা করেছিলেন? আর দাঁড়ান দাঁড়ান, এই সময়ে আপনার কাছে গিফটই বা কেন ছিলো? আপনার চিত্রনাট্যে কিন্তু প্রচুর প্লটহোল।

– দেখুন দাদা, নিজে এসে জানতে চাইলেন, তাই বলছিলাম। প্লটহোল না ব্ল্যাক হোল সেসব যাচাই করতে চাইলে আগে বাড়ুন। আর হ্যাঁ, ম্যানহোল দেখে হাঁটবেন।

– বাহ। আপনি একের পর এক আজগুবি কথা বলবেন, পয়লা বৈশাখে ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসের ভেতর একটা লাল-সাদা কোট চাপিয়ে নিজেকে সান্তা ক্লজ দাবি করবেন আর আমি মেনে নেব? কই? আপনার তো সান্তা ক্লজের মতো গালভরা সাদা দাড়িও নেই? গায়ের চামড়াও ময়লা।

– আহা আমার কী দোষ! সব খুইয়ে তখন মন খারাপ করে হাঁটছি তো হাঁটছি। ভোরের আলো মাত্রই ফুটেছে। দেখলাম পথের ধারে এক দোকানের ঝাঁপ তুললো কেবল। দোকানের লোকটাকে বললাম, সেভ মি, সেভ মি প্লিজ! তখন লোকটা বললো, সেভ হবেন? আইয়ে বেঠিয়ে না। আভি করিয়ে দিচ্ছি। কিছু বোঝার আগেই ক্ষুর চালিয়ে স্যাঁত্!

– আর গায়ের চামড়ায় কী করলো? অ্যান্টি ফেসিয়াল ট্রিটমেন্ট?

– আরে না না! ক’দিন আগেই আরেক বার এমন যান্ত্রিক গোলযোগে ক্যারিবিয়ান সি-বিচ পৌঁছে গিয়েছিলাম। এমন ট্যান হয়েছি দাদা কী বলবো যাকে বলে মাদার অব সান-ট্যান!

– সবই না হয় বুঝলাম। তা এখন ফেরত যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন।

– যাবো তো বটেই। সামনেই একটা ইন্টারগ্যালাকটিক্যাল অকেশন আছে। টেকনিক্যাল কারণে অকেশনটার নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। সেসময় ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সে পর্যন্ত সারভাইভও করা লাগবে। সেজন্যেই এই পান্তা বিজনেস করে দু’টো ট্যাকাটুকা কামিয়ে নিচ্ছি। সান্তা’র সাথে পান্তা মিলিয়ে নামটা রেখেছি। এখানে এরকম উদ্ভট নামের কারবার ভালোই বিকোয়।

– বটে। এখানকার কালচার নিয়ে রিসার্চও করেছেন দেখছি। ওদিকে পান্তা খেতে দিচ্ছেন ভর্তার সাথে? ইলিশ কই?

– আহাহাহাহাহা! নববর্ষে পান্তার সাথে ইলিশ খাওয়ার বুঝি খুব যোগাযোগ আছে? হাহাহাহা।

কী এমন বললাম, লোকটা হেসেই যাচ্ছে। হেসেই যাচ্ছে। বিরক্ত লাগা শুরু হলো। লোকটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিলো না। রেগেমেগে বললাম,

– না না, পয়লা বৈশাখে পান্তার সাথে যোগাযোগ আছে বানোয়াট সান্তার।

ব্যস্, হাসির দমক আরো বেড়ে গেলো বুড়োর। হাহাহাহা-র পর হো-হো-হো করে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হাসি। বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। চেহারা দেখছিলাম না, কিন্তু হাসি তো ঠিকই কানে আসছে। আচ্ছা ওর ‘হো-হো’ করে হাসিটা এখন দেখি সান্তা ক্লজের হাসির মতোই লাগছে এখন। হ্যাঁ, ঠিক তাইই তো। বলবো নাকি ওকে সে কথা। না বলি। চেহারাটা ঘুরাই।

এ কী!

ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে সব। সান্তা-পান্তা কোথাও কিচ্ছুটি নেই। খালি কানের মধ্যে ‘হো-হো-হো’ বাজছে। মনে হচ্ছে কে যেনো বলছে, হো-হো-হো-শু-ভ-ন-ব-ব-র্ষ!

বোশেখের গরমটা বেশিই লাগছে এখন। জোর বৃষ্টি হলে গরমটা মনে হয় একটু কমবে।