মুভি দেখাটা অনেকের কাছেই স্ট্রেস কমানোর একটা অন্যতম মাধ্যম। টানা মুভি দেখলে শরীরের ওপর ধকল পড়ে ঠিক, কিন্তু মনের উপর পড়ে না। তাই সিনেমা দেখার কষ্টকে আর কষ্ট লাগে না। মুভি দেখতে স্ট্রেস লাগে না, তবে কী দেখলাম তা নিয়ে কিছু লিখতে কিন্তু রাজ্যের স্ট্রেস ভর করে। আবার ধরুন চলচ্চিত্রটি যদি তথাকথিত একটু ছুৎমার্গ ঘরানার হয় তাহলে তো কথাই নেই। স্ট্রেস কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় যদি বা লিখতে বসলামও, কী লিখলে ঠিক নিজের গায়ে লাগবে না, কার অনুভূতি নাড়া খাবে না ইত্যকার বিষয়াদির প্রভাবে ওয়ার্ডে কালো অক্ষরগুলো একবার ভেসে ওঠে, আবার ডিলিট হয়। আবার নতুন চেহারায় অক্ষরগুলো আসে, আবার মুছে যায়। এখন তো আর কাগজে-কলমে লেখার দিন নেই। নইলে মুঠ পাকানো দলা দলা কাগজ চারপাশে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যেতো। আর শুধু লেখার কথা বলছি কেনো, সমপ্রেম নিয়ে বানানো মুভি দেখা নিয়েও তো মনে খচ খচ আর চোখেতে সংকোচ কাজ করে। তবে ওসব কাটিয়ে যদি উঠতে পারেন তাহলে একটা চমৎকার মুভি দেখার অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ‘কল মি বাই ইয়োর নেম’ মুভিটির প্রসঙ্গে বলতেই হয় এ কথা। হলিউডের অ্যাওয়ার্ডের মৌসুমে যে মুভিটা কয়েকটা প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ডের বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে নমিনেশনও পেয়ে শেষতক বেস্ট অ্যাডাপ্টেড স্ক্রিনপ্লের জন্য অস্কার আর রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
মুভির প্রেক্ষাপট গত শতকের আশির দশক। গল্পটা ইলিও-র। ইলিও’র বয়স সতেরো পেরিয়েছে। তবে সদ্য কৈশোর পেরোলেও সে কিন্তু মোটেও ছোট্টটি নয়। তার একটা গোটা বান্ধবীও আছে। ইতালির এক মনসুখকর দৃশ্যসম্বলিত প্রায়-গ্রাম প্রায়-শহর এলাকাটিতে বান্ধবীর সামনে নিজেকে ম্যাচিওর প্রমাণে সে সদা তটস্থ। সবই ঠিক চলছিলো। তারপরে একদিন তার বাবার রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে এলেন এক ভদ্রলোক। নাম তার অলিভার। বয়সে ইলিও’র চে’ বেশ ক’বছরের বড়। চলনে-বলনে পুরো বিদেশি। আর কথায় কথায় কেমন যেনো দূরত্ব বজায় রাখা তার অভ্যেস। আবার তার মানে এ-ও না সে মুখচোরা। কথা বলে প্রচুর। তবে নিজের ইচ্ছেয়। সুযোগে-সময়ে জ্ঞান বিতরণেও কয়েকধাপ এগিয়ে। এমন হামবড়া, এমন সবজান্তা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ভদ্রলোক; ইলিও তাকে মেনে নিতে পারে না শুরুতে। যদিও তাকে নিজের ঘরে জায়গা দেয়া, এমনকি লোকটার সুটকেস পর্যন্ত নিজে বয়ে ওপরে তোলার কাজটাও আগবাড়িয়ে সে-ই করেছিলো। আসলে বাবার কাছে প্রতি বছরই এমন একজন গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট আসে। সামারে বাবাকে অ্যাসিস্ট করে ফিরে যায়। তবে ইলিও বাজি ধরে বলতে পারে বাকিরা এই ভাবধরা অলিভারের মতো অ্যারোগেন্ট নয়। মেয়েদের কানাকানি-ফিসফাসও কানে এসেছে তার। এতোটা হ্যান্ডসামও নাকি বাকিরা নয়। তাই কি? ইলিওর যে বারবার কানে লাগে অলিভারের ভাব নিয়ে ‘লেটার’ (later) বলাটা। একদিন ডিনারের আগে যখন অলিভার যথারীতি ‘লেইট’, সেসময় ইলিও ঠিক কথাটা তোলে। “দেখো তোমরা, যাবার সময়ও এমন ‘লেটার’ বলেই ফুরুৎ হয়ে যাবে।” বোকা ছেলের ছেলেমানুষি এ অভিযোগ কারো কাছেই পাত্তা পায় না। “কেন এটিকে এতো গুরুত্ব দেয়া, ইলিও?” ওদিন থেকেই মন খারাপ হওয়া শুরু ইলিওর। অলিভারের জন্য জমতে থাকে অভিমান। তারপর? তারপর কীভাবে যেনো পুরোনো বাড়ির দেয়াল, নদীর পাড় আর মন ভালো করে দেয়া সবুজের মাঝে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে সব অভিমান-অনুযোগ অনুরাগে বদলে যেতে থাকে। ইলিও সেটা বুঝতেও পারে না। পুরোটা বলা একদমই অনুচিত হবে। মুভিতে ডুব দিয়ে দেখে নিন। শুধু বলছি, যেমনটা অনুমেয়, তেমন করে আস্তে আস্তে এক পর্যায়ে অলিভারকে নিয়ে না-ভালো, না-বিচ্ছিরি এক ভালোলাগায় জড়িয়ে যায় ইলিও। এ এমন ভালোলাগা, যেটা বন্ধুত্বের সীমানা কীভাবে করে যেনো পার হয়ে যায়। এমন ভালোলাগা, যেখানে একে অপরকে নিজের নাম ধরেই ডাকা যায়। এ এমন ভালো লাগা, আশির দশকের গ্রীষ্মে যে ভালোলাগার কথা কাউকে বলাও যায় না।
আশির দশকে বলা যেতো না। এখন যায় কি? কঠিন। বলা যেমন। বোঝাও তেমন। এখনও। তাইতো ইলিও-র, কিংবা বছর সতেরোর একটা কিশোরের অবস্থান থেকে দেখতে না পারলে ‘কল মি বাই ইয়োর নেম’-কে একটি ভালোবাসার গল্প হিসেবে মেনে নেয়াটা কঠিন। আর সে জায়গা থেকে দেখতে পারলে, আবারো বলছি, ‘কল মি বাই ইয়োর নেম’ হতে পারে চমৎকার একটি চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতা। যা হচ্ছে সেটা আপনার সমর্থন করার দরকার নেই। তবু দেখে যান। মুভির শেষে ইলিও’র জন্য একবুক হাহাকার ঠিক জমা হবে। আপনার জায়গা থেকে হয়তো ভাববেন, ইলিও বা অলিভার, এদের যেকোনো একজন বিপরীত লিঙ্গের হলে কী হতো? স্বাভাবিকভাবেই কী হতে পারতো বা পারতো না সেটি আপেক্ষিক বিষয়। ছেড়ে দিন না। কারো প্রেমে পড়ার জন্য কারণগুলোর তালিকা তো আর নির্দিষ্ট নয়। ওদের জন্য না হয় তালিকায় আরেকটা বিষয় যোগ হয়েছে।
নেটে ঘেঁটে দেখি যাচ্ছে অনেকেই বলছেন মুভিটা তার বইকেও ছাড়িয়ে গেছে। অত্যন্ত বিরল ঘটনা। প্রকাশিত জনপ্রিয় কিংবা আলোচিত উপন্যাস বা গল্প থেকে যখন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আফসোস থাকে। বইয়ের মুগ্ধতাটা সিনে পর্দায় উঠে আসতে না পারার আফসোস। ‘কল মি বাই ইয়োর নেম’-এ সে অতৃপ্তি নেই। তাই চাইলে মুভিটা আগে দেখে তারপর বইটা নিয়ে বসতে পারেন।
এরপরই আসবে সেই বড় প্রশ্ন। প্রেমকাহিনী বলে ডাকবেন তো? আপনাদের বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম। দেখে আপনারা যা বলবেন সেটাই হবে।
চলচ্চিত্র: কল মি বাই ইয়োর নেম
মূল উপন্যাস: কল মি বাই ইয়োর নেম;
লেখক: আন্দ্রে আসিম্যান
পরিচালক: লুকা গদ্যাগনিনো
চিত্রনাট্য: জেমস আইভরি
অভিনয়: টিমোথি শ্যালামে, আর্নি হ্যামার, মাইকেল স্টালবার্গ প্রমুখ।