ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে লাল সবুজ পতাকা। যে পতাকা সুনীল আকাশে দীপ্ত ভঙ্গিতে উড়ছে, যার সবুজের মাঝের টুকটুকে লালটা এমন স্বতঃস্ফূর্ত যে কোনো বিরাম সেখানে নেই, বাঁধা নেই, ক্লান্তি নেই, নেই কোনো অবসাদ। এই লাল সবুজের পতাকা, আমাদের পতাকা, বাংলাদেশের পতাকা। এ পতাকার জন্য, স্বাধীনতার জন্য দুই লক্ষ মা-বোন একাত্তরে নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিলেন।
তাদের আমরা কি দিতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কিভাবে বেঁচে ছিলেন তাঁরা? সেই মায়েদের, সেই বোনদের মধ্যে সকলের হয়ে প্রথম বাক্যস্ফুর্তি হয়েছিল ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর। যিনি একজন বীরাঙ্গণা, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সাহসী দৃপ্ত সৈনিক, একজন ভাস্কর এবং একজন সদাহাস্যময়ী মা।
জীবনের প্রতিটি পদে সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন, টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। জীবনের রঙিন সময়গুলো উপভোগ করতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার পরেই বিশাল সংসারের হাল ধরেন অল্প বয়সে। একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তির সংগ্রামের সময়েও সংসারের বাকি সদস্যদের মুখে দুটো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য জুট মিলের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। সেই সংকটের সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনের শিকার হন তিনি, বহুবার।
শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি’ বইয়ে প্রিয়ভাষিণী অকপটে সেই স্মৃতির কথা বলেন। পাকিস্তানি মেজরদের শারীরিক অত্যাচার নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে ২৮ ঘণ্টা চেতনাহীন ছিলেন তিনি। প্রতি রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের শারীরিক অত্যাচারের শিকার হওয়ার ভয়ানক স্মৃতি তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে বাকিটা জীবন। চোখ বন্ধ করলেই তিনি জানোয়াররূপী সেই পাকিস্তানিদের মুখ দেখতে পেতেন। এ যে কী বীভৎস যন্ত্রণা, কী মানসিক কষ্ট তা তিনি লিখেছেন ‘নিন্দিত নন্দন’ বইয়ে।
যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে বীরাঙ্গণাদের জীবন সহজ ছিলোনা। অনেকেই দেশ ছেড়েছেন, কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন, কেউবা আত্মহত্যা করেছেন, কেউ আবার নিজের পরিচয় গোপন করে কোনোভাবে বেঁচে রয়েছেন। বীরাঙ্গণা হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়ার বিষয়টি সর্বপ্রথম জনসন্মুখে তোলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তার পরে অনেক দেখেছেন, অনেককে দেখেছেন। কিছুই প্রিয়ভাষিণীকে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি।
শুধু বীরাঙ্গণা ইস্যুতে জনসন্মুখে কথা বলেছেন তাই-ই নয়, ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলনের সময়েও ছিলেন সক্রিয়।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, বীরাঙ্গণা মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস। ২০১৮ সালের ৬ই মার্চ তিনি নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে গেলেও রয়েছেন আমাদের সর্ব মঙ্গলের আলোকবর্তিকা হয়ে।