‘হাম পাঁচ’-এর কথা মনে আছে? নাইন্টিজ কিডস উইল রিমেমবার। একতা কাপুরের বালাজি টেলিফিল্মসও সেসময় শাশুড়ি-বউয়ের কেচ্ছার বাইরে কিছু প্রোডাকশন বানাতো। তার একটা প্রমান ওই ডেইলি সোপ। এক মধ্যবিত্ত ছাপোষা বাবার দুই পক্ষ মিলিয়ে পাঁচ মেয়ের রোজকার আজব কীর্তিকলাপ আর তাতে তাদের বাবার নাজেহাল হওয়াই ছিল স্টোরিলাইনের মূল ভিত্তি। বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী গত হয়েছেন বহুকাল, কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো তার ছবির সাথে স্বামীর নিয়মিত কথা হয়। তাতেও সংসারের কর্তার অসহায়ত্বই প্রতীয়মান হয় বারে বার। আবার বর্তমান স্ত্রীর ‘প্যারা’ তো আছেই। ওদিকে মেয়েগুলো তো একেকদিন একেক কাণ্ড ঘটায়। তার মধ্যে একবার তাদের মাথায় ঢুকলো ম্যাগাজিন বের করার আইডিয়া। গসিপ ম্যাগাজিন। ছাপা হয়ে বেরিয়েও গেলো। সে কী সব রোমহর্ষক ‘আই-ক্যাচি’ হেডলাইন ম্যাগাজিনে। অথেন্টিসিটির বালাই নেই! যা ইচ্ছা তাই হেডলাইন। তবে ভেতরে ‘মাল’ অন্য। আবার ধরা খাওয়ারও চান্স নেই। কারণ প্রতিটা হেডলাইনের শেষেই থাকে বিরাট বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন! অর্থাৎ স্টেটমেন্ট নয়, সন্দেহ প্রকাশ। দায়ভার নেওয়ার দায়িত্বই নেই।
সিরিয়ালটা প্রায় বছর বিশেক আগের। তবে ওইরকম দৃষ্টি আকর্ষী হেডলাইনের ব্যবসার রমরমা চলছে এখন। অন্তত ইন্টারনেটের বাজারে। অর্ন্তজালের ভাষায় যাকে বলে ক্লিকবেইট। অর্থাৎ যে হেডলাইন পড়িয়ে ইন্টারনেটের সাগরে আপনাকে টোপ দেয়া হবে, আপনি টোপ গিলে মহার্ঘ্য ক্লিকটি করবেন। আর তরী ভেড়াবেন তাদের সাইটের ডাঙায়। ওয়েবসাইটে ট্রাফিক জেনারেট করার এ বেশ জোরদার এক ব্যবসা। এই ট্রাফিক দেখিয়েই তো তারা জিডিএন বা ব্যানার অ্যাড বেচে দু’টো ট্যাকাটুকা কামিয়ে নিচ্ছে। তবে পাঠকের সাথেও এ পুরোপুরি না-ইনসাফি। তাইতো বলা হয়ে থাকে, ইন্টারনেটে ঘোল খেতে না চাইলে দু’টো জিনিস থেকে সাবধান। প্রথমটা হচ্ছে ফেসবুকে যাই দেখি, তাই-ই বিশ্বাস না করা। দ্বিতীয়ত, বায়বীয় নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের নিউজ দেখলেই তাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে না নেওয়া। এভাবেই কিন্তু ইন্টারনেটের পাল্লায় পড়ে অনেক অমুসলিম সেলিব্রেটি নিয়মিত ইসলাম গ্রহণ করেন, চাঁদ-মঙ্গল মায় ইউরেনাসেও বিভিন্ন জনকে দেখা যায়। আবার নিয়মিত পাওয়া যায় অনেকের মৃত্যুসংবাদও। হেডলাইনের ক্লিকবেইটের ফাঁদে পড়ে পরে দেখা যায়, হয় সেটা কোনো নাটক বা সিনেমার প্লট। নয়তো নেহায়েত মিথ্যার জটাজাল।
তো তাহলে ইন্টারনেটে তাক লেগে যাবার মতো নিউজ দেখলে আপনি কি করবেন? প্রথমেই চেষ্টা করবেন নির্ভরযোগ্য নিউজ সাইটে খোঁজ নেওয়ার। তাতে না কুলোলে? যথারীতি গুগল মামার শরণাপন্ন হতে পারেন। কারণ আপনি জানেন গুগল মামার দুয়ার হতে, কেউ ফেরেনা খালি হাতে। কিন্তু সেই ভরসার জায়গাটা মনে হয় আর নেই। তার প্রমান দিলেন যেনতেন ‘ম্যান’ নন, খোদ সুপারম্যান। গুগল জানালো ম্যান অব স্টিল চরিত্রে রূপদানকারী হেনরি ক্যাভিল আর নেই। ৩ মার্চ তিনি ছেড়ে চলে গেছেন এ নশ্বর পৃথিবী।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে নেমছে শোকের ছায়া। কিন্তু এত্ত বড় এই খবরটা ধামাচাপা পড়লো কী করে? নেটিজেন এরচে অসহায়ত্ব আর কখনো বোধহয় বোধ করেনি। খবরটা আসল না ভুয়া তা জানতে ভরসার আশ্রয়স্থল গুগল-এর কাছেও যা্ওয়ার উপায় নেই। যা হোক। পৃথিবীবাসী যখন শোকে কী করবে তা নিয়ে সন্দিহান, ঠিক তখন শকে মূহ্যমান একজনের একটা ইনস্টাগ্রাম পোস্টেই সবার কনফিউশন দূর হলো। কেনো হবে না? পোস্টটা যে দিয়েছেন হেনরি (ক্যাভিল) নিজেই। ছিটেফোঁটা সব দ্বিধা দূর হওয়ার পর জানা গেলো সেটা ছিলো একটা ইন্টারনেট গ্লিচ। সাময়িক ম্যালফাংশন। কী করে সেটা হলো এখনো জানা যায়নি অবশ্য।
যাই হোক। হেনরি’র পোস্টে কেউ শোক প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ গুগল-এর শাপশাপান্ত করেছেন। তবে ইন্টারনেটে সরেস লোকজন যে সব জায়গাতেই আছে। নানান দেশেই যে যার যার মতো চলে নোয়াখালী বিভাগ আর চিকন পিনের চার্জার খোঁজার আন্দোলন, তার প্রমাণ হেনরি ক্যাভিলের পোস্ট। সেটায় জনৈক স্মার্টফোন গবেষক হেনরি’র দেয়া স্ক্রিনশট পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন ওটা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের দোষ। তার সূত্র ধরে কারো কারো প্রশ্ন ডিসি-র পেচেক কি এতোই কম যে হেনরি একটা আইফোন এফোর্ড করতে পারে না? আবার কেউ কেউ জানান, “এ আর এমন কী। আমি ‘ডন অব জাস্টিস’ তিনবার দেখেছি। তার মানে তোমাকে তিনবার মারা যেতে দেখেছি।” কেউ আবার হেনরির চেহারা দেখে যারপরনাই খুশি। এ তো সাক্ষাৎ রিবার্থ। পুনর্জন্ম! মাদার বক্স ছাড়াই। একজন আবার জানালেন “লুকিং প্রিটি হট ফর আ ডেড বডি।” আহা! মরার খবর দিয়েও দেখি দুনিয়ায় শান্তি নেই।
লেখার এ পর্যায়ে এসে পাঠক, দোষ স্বীকার করছি। এর হেডলাইনটা আপনাকেও ‘ক্লিক-বেইট’-এর শিকার বানিয়ে একটি অহেতুক লেখা শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করেছে। এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আশা করি, এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আপনার ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।