যে কারণে চাই না ‘কোবরা ড্যান্স’

সকলেই ক্রিকেটবোদ্ধা নন, অধিকাংশেই ক্রিকেট নামক বৈশ্বিক খেলাটার অনুরাগী মাত্র। খেলা দেখতে ও উপভোগ করা থেকেই আরো অনেকের মতো আমরাও বুঝি যে, ক্রিকেট নামের এই খেলাটা বাংলাদেশে আমরা খেলি যেমন আবেগ দিয়ে, দেখিও সেভাবেই। ক্রিকেটে জয় আমাদের সেই আবেগকে নাড়া দিয়ে যায়। শুধু জয় না। মাঠের অনেক ছোটো ঘটনাও আমাদের ছুঁয়ে যায়। নিরাপত্তার প্রোটোকল ভেঙে মাঠে ঢুকে পড়া পাগল ভক্তকে নিরাপত্তাকর্মীদের থেকে রক্ষা করতে মাশরাফি যখন নিজে আগলে ধরেন, সেটা দেখে আমরা আবেগতাড়িত হই। কয়েকটি রানের ব্যবধানে পরাজয় এলে খেলোয়াড়দের অশ্রু আমাদেরও চোখ ভিজিয়ে দেয়। আর জয় এলে? উল্লাস হয়, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস হয়। অতি আনন্দে টুপ করে জল নামে চোখের কোণ বেয়ে। তখন আড়াল খুঁজি। সবার অলক্ষ্যে শার্টের কোণে সেই পানি লুকাতে চাই। অনেক পোড় খাওয়া জাতি তো, এ ধরনের অর্জনগুলো তাই আমাদের কাছে বড় বেশি স্পেশাল।

জীবনের যে মাঠেই হোক, জয় সবসময়ই মধুর। সবসময়ই আনন্দের। এবং জয় উদযাপনেরই বস্তু। তবে উদযাপনেরও ধরন আছে। কিছু উদযাপন নির্মল, বিনোদন যোগানিয়া। যেমন ধরুন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর মাঠে গ্যাংনাম স্টাইল। ইংল্যান্ডের স্টোকসকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সাকিবের স্যালুট। ওগুলোর সাথে আমরা দর্শকরাও একাত্ম হই। তবে উদযাপনের মাঝে যদি থাকে উচ্ছৃঙ্খলতা কিংবা কাউকে অসম্মান, কিংবা কাউকে ‘দেখিয়ে দেয়া’র ইঙ্গিত, সেটিকে নিরুৎসাহিত করাই কি ভালো না?

আপাতদৃষ্টে কোবরানৃত্য বা সাপের মতো ভঙ্গিমা দেখিয়ে উদযাপনে দোষের কিছু নেই। বিপিএল-এ নাজমুল অপু গত দুই সিজন ধরে উইকেট পেলে একলাই এই উদযাপন করে আসছেন। এরপর তিনি জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর সেটা সংক্রামিত হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। সেটা ঘরের মাঠে বছর শুরুর ত্রিদেশীয় সিরিজের সময়। ফাইনালের পরাজয়ের পর ওই উদযাপন উল্টো দেখা গিয়েছিল শ্রীলংকার ক্রিকেটারদের মাঝে। হারের জ্বালায় নীল দর্শক তখনো বোঝেনি নাগিন নৃত্যের তীব্রতা। নিজেদের ঘরের মাঠে টুর্নামেন্ট হারানোর সে বেদনা ফিরে এসেছিল পর্বতসম টার্গেট পেরিয়ে অবিশ্বাস্য জয়টা পেয়ে মুশফিকুর রহিমের মাঝে নিদাহাস ট্রফিতে খেলতে গিয়ে । আবেগের বশে আরও অনেক কিছুর সাথে হয়ে গেল এক দফা কোবরা ড্যান্স-ও। ব্যস! ভাইরাল হতে হতে সেটাই হয়ে গেলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন অপ্রত্যাশিত ট্রেডমার্ক। পরের ম্যাচে তাই বাংলাদেশ টিমের উইকেট পড়লেই পাল্টা নেচে খোঁচা দিতে শ্রীলংকান খেলোয়াড়, দর্শক কেউই ছাড়েনি। স্পিকার আকিলা গুনাতিলকা তো বীন বাজিয়ে, ছোবল দেখিয়ে বারবার উসকেছেন। সেগুলো দেখে গা জ্বলেছে? তাহলে জেনে রাখুন, আমরা যখন দেখিয়েছি তখন তাদেরও জ্বলেছিলো।

তো ওরা দেখিয়েছে, আমাদেরও বেশি বেশি দেখানো উচিৎ, আমাদেরও দেখিয়ে দেয়া উচিৎ কোবরা-র বিষছোবল কেমন, এভাবে পাল্টাপাল্টি ‘দেখে নেয়া’র রেওয়াজ পাড়ায়-পাড়ায় গ্যাঞ্জামের সময় তাও খানিকটা মানায় কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে!

দুঃখিত, মেনে নেওয়া কঠিন। তাই ব্যক্তিগত এ উদযাপন ড্রেসিংরুমের জন্য থাকুক। বিপক্ষ খেলোয়াড়দের জন্য নয়।

আচ্ছা ভাবুন তো, বিরাট কোহালি বা শহিদ আফ্রিদিরা মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে এসে আমাদের সাথে ম্যাচ জেতার পর দর্শকের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ করে নর্তনকুর্দন করলেন। কেমন লাগবে? দর্শক হিসেবে আমরা মেনে নেবো সেটা? সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাবে না এরপর? সেটা যদি আমরা মেনে না নেই তাহলে ভিনদেশের দর্শকদের ছোট করে, তাদের উস্কে দিয়ে কী লাভ? আমরা দেখাবো ব্যাট-বলে। অঙ্গভঙ্গি করে নিজেদের অসম্মান ডেকে আনবো কেন? এর আগে কাটার মাস্টারের কাটিং সেলুন নিয়ে স্যাটায়ারের পানি যতোদূর গড়িয়েছিলো তা কিন্তু সুখকর ছিলো না। ওই এক ঘটনার রেশ ধরেই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে তা ক্রিকেটভিত্তিক পেইজগুলোর কমেন্ট সেকশন থেকেই জানা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, সেটা নিয়ে উত্তেজনাও থাকবে। কিন্তু সেগুলো সৌজন্যবোধ আর শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যাবে, সেটা কেমন কথা?

বলতে পারেন আমরা থামালেই ‘ওরা’ বন্ধ করবে তা নিশ্চিত করবে কে? আরে আগে তো ‘আমরা’ বন্ধ করি। সেজন্যেই বলছি, কোবরা ড্যান্স বন্ধ হোক। শালীনতার বাউন্ডারি পেরিয়ে যাবার পটেনশিয়াল যে এর অনেক বেশি সেটা তো দেখে ফেলেছেনই। খেলোয়াড়রা মাঠে আগ্রাসী মনোভাব দেখালে সেটা নিয়ে কথা হয়, চর্চা হয়। এগুলো এন্টারটেইনমেন্টের অংশ। খেলায় সর্বোচ্চ সাফল্য পেতে আগ্রাসন প্রয়োজনীয়। তবে ওই যে, আবারো একই কথা। শালীনতার একটা সীমা রেখে। ক্রিকেট জেন্টেলম্যান’স গেম। জানি, এই কথাটি দিয়ে কুলীন সম্প্রদায় খেলাটা কারা খেলার যোগ্যতা রাখে সেবিষয়ে স্পষ্ট একটা গণ্ডি কেটে দিয়েছিল। বড় কষ্টে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে টি-২০’র কাঁধে চেপে ক্রিকেট আজ সর্বস্তরের মানুষের খেলা।

কিন্তু সর্বস্তরের খেলাতেও দর্শকদের উপহাস করা হয় না। যেভাবে উদ্ধত-উদ্দাম গতিতে এগোচ্ছে কোবরা-নৃত্য, ভদ্রতাবোধ দেখানোর জায়গাটা থেকেই না দূরে সরে যায় টাইগাররা।

শেষ পয়েন্ট। আর এটাই সবচে’ যৌক্তিক। আমরা তো টাইগার্স। বঙ্গশার্দুল। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার্স। ক্রিকেটবিশ্ব আমাদের এ নামেই চেনে। ক্রিকেট বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং কিন্তু বাঘকে ঘিরেই। ক্রিকেটের এ বিশ্বে সিংহ প্রতীক বুকে এঁকে খেলে দু’টো দল- শ্রীলংকা আর ইংল্যান্ড। তবে বাঘ কিন্তু একটাই। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের লোগোয় বাঘ। যার সুবাদে হেড গিয়ারে বাঘ, জার্সিতে বাঘ। মোটকথা ক্রিকেট টিম যেখানেই যা করে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে প্রতিনিধিত্ব করে সবজায়গাতে বাঘেরই উপস্থিতি। সুন্দরবনের সুন্দর এ প্রাণিটি কিন্তু শুধুই আর একটা প্রাণি না, জাতীয় প্রাণি বাংলাদেশের। একে ঘিরে আমাদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করে। সুন্দরবন বিপন্ন হবার আশংকা দেখলে বাঘের দুর্গতির ভাবনাটাই আসে সবার আগে। আমাদের বড় অহঙ্কার, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আমাদেরকে এর নামেই পরিচিত হতে দিন না। সাপ টেনে এনে কেন খামোখা কনফিউশন তৈরি করা?

তাই মাথা ঠান্ডা রাখুন টাইগার্স। এখনো প্রমাণ করার আছে আরো অনেক কিছু্ই। দেখানোরও আছে। তবে সেটা ব্যাট-বল দিয়েই। আর টাইগার ফ্যানস, চলুন একটু সংবরণ করি নিজেদের। খারাপ দিন আসতে পারে যেকোনো দিন। যেকোনো সময়। পরে আমাদের নিয়ে বাকিদের মজা লোটার সুযোগ কেনো দেবো? টাইগারদের টাইগারই থাকতে দিন। বাঘ হুঙ্কার দেয়, থাবা মারে, ছোবল নয়।