বিশ্বজয়ের শেষ বাধা দূর করা কোবরা ড্যান্সার টাইগার্স

আজ থেকে ঠিক ২১ বছর আগে এই দিনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফিটা উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন শ্রীলংকার কিংবদন্তী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। আজকের দিনে এসে শ্রীলঙ্কার এই বিশ্বজয়কে যদিও খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপার হিসেবে দেখার কিছু নেই, তবে ৯৬ সালে সেটা ছিলো অভাবনীয় এক ব্যাপার।

লংকানদের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা

মার্কিন লেখক ওয়াশিংটন আরভিং রিপ ভ্যান উইংকেল নামে এক চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। রিপ ঘুমিয়ে ছিলেন ২০ বছরের জন্য ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে আশেপাশের সব কিছুর পরিবর্তন দেখে রিপ তো পুরোই হতবাক।

তবে রিপের মতো ২০ বছর না, এমনকি দশ বছরও না, এর আগে স্রেফ পাঁচ বছর ক্রিকেট খেলার কোন খবর না রাখা মানুষ যদি হঠাৎ করে ৯৬ সালের বিশ্বকাপটা দেখতে বসতেন, তিনি হয়ত রিপের চেয়েও বেশি অবাক হতেন।

বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রীলংকা এককালে ছিল ঠাট্টার পাত্র। রয় ডায়াস, বেন্ডন কুরুপ্পু ইত্যাদি দু-চারটা নাম ক্রিকেটামোদীরা জানলেও এই দল ছিলো অন্যদের বাঁধা সহজ শিকার। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার স্যার গারফিল্ড সোবার্সের কোচিঙে দলটা ধীরে ধীরে উন্নতি করছিলো ঠিকই, তবে বিশ্বজয় তো দূরের কথা, নিয়মিত জেতাটাও তাদের হয়ে উঠছিলো না। সেই নব্বই দশকের গোড়ায় যখন প্রতিটা খেলার স্কোরবোর্ড মুখস্থ রাখার লড়াই চলতো স্কুলে তখন শ্রীলংকা ছিল কেবলই একটা লড়ুয়ে দল, যারা খেলাটায় শেষমেশ হেরেই যায়। অবশ্য এরা অত্যন্ত ‘বিনয়ী’ ও ‘ভদ্র’ দল; অস্ট্রেলিয়া, ভারত কিংবা ইংল্যান্ডের মতো মোড়লগিরির ট্যাকের জোর এদের নেই, আর উইন্ডিজের মতো বীরবিক্রম যে নেই তা বলাই বাহুল্য।

চিত্রনাট্যের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলেন ‘আইয়া’ (শ্রীলংকান ভাষায় বড় ভাই) রানাতুঙ্গা। প্রবল প্রতাপশালী, স্লেজিং পটু অস্ট্রেলিয়ানদের একেবারে ঘরের মাঠে গিয়ে। সিংহের ডেরায় গিয়ে সেই ‘ভদ্র’ ক্রিকেটারগুলো আঁচড়ের বদলে কামড়ে দিলো, চিমটির পাল্টা দিলো খামচি আর হুংকারের বিপরীতে করলো গর্জন।

বিশ্বকাপজয়ী ‘আইয়া’

হাস্যকর ভুড়ি, দৌড়ের বদলে প্রায় হেঁটে হেঁটে রান নেওয়া রানাতুঙ্গা নিজের পুরো দলকে বোঝালেন যে ভিক্টোরিয়ান গেম ক্রিকেটে ‘ভদ্রতার’ নামে অন্যায় মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। ব্রিটিশরা এই খেলাটি আবিস্কার করে বলেছিল, এটা ভিক্টোরিয়ান আদর্শের প্রতীক। এখানে বাবুমশাইরা ব্যাট করবে, কামলারা বল ছুড়বে আর ঐ যে সাদা কোট পড়া ভদ্রলোক সর্বশক্তিমান, তিনি যাই বলুন না কেন, সেটির বিরুদ্ধে ট্যাঁফো করা যাবে না।

ইতিহাস সাক্ষী, শত শত বার শুধু এই নিয়মের দোহাই দিয়ে সাদা কোটওয়ালারা নিপীড়িতের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। রানাতুঙ্গা নিজেই এমনটা দেখেছেন আকছার। তাই তিনি ভাবলেন, আর না! সনৎ জয়সুরিয়ার ব্যাটকে তলোয়ার বানিয়ে নতুন ধরনের আগ্রাসন যেমন তিনি মাঠে দেখিয়েছেন তেমনি আম্পায়ারের অন্যায়কে তিলমাত্র ছাড় দেননি।

অস্ট্রেলিয়ানরাও বিস্ময়ে দেখলো যে, এই কালা আদমিরা ফুঁসে উঠছে। আন্ডারআর্ম বোলিং করে জয় নিশ্চিত করা, হ্যারল্ড লারউডের বাউন্সারে কেঁদে কেটে আইন পরিবর্তন করার আকুতি জানানো, স্লেজিংয়ের নামে নোংরামিতে অভ্যস্ত সাহেবরা তখন হঠাৎ করেই নীতিশিক্ষার গুরুমশাই সাজলেন আইয়াকে নিরস্ত করতে। তবে শেষরক্ষা হয়নি, পরের বছর সেই অস্ট্রেলিয়াকেই ফাইনালে হারিয়ে জিতে গেল শ্রীলঙ্কা। এক অবিশ্বাস্য ক্রিকেটিং রূপকথার জন্ম দিয়ে।

সোবার্সের কারনে, নাকি দ্বীপদেশের লোক হবার কারনে নাকি গায়ের রংয়ের মিলের কারনে কিংবা হয়তো সবগুলোর মিশেলে লংকানরা উইন্ডিজের মতোই খেলাটাকে ভীষন আক্রমণাত্নক মনোভাব নিয়ে খেলতে শুরু করলো। আর এরকম সর্বস্ব দিয়ে খেলতে গেলে অন্যায়ের প্রতিবাদটাও যে করা জরুরি। রানাতুঙ্গা নিশ্চিতভাবেই জানতেন কিভাবে ক্লাইভ লয়েড বিশ্বজয়ী উইন্ডিজ দলটাকে এই নিজস্ব ধরনের মানসিকতায় গড়ে নিয়েছিলেন।

আম্পায়ারের কাজ-কর্ম কিস্যু হয়না। ফয়সলাবাদে মাইক গ্যাটিং

মাইকেল হোল্ডিংকে ‘হুইসপারিং ডেথ’ বলা হতো কি কেবল পেসের জন্য? লিলি, থম্পসন কিংবা গার্নারের পেস কি কম ছিলো? হোল্ডিং ছিলেন মেজাজি, অন্যায় মানতে না পারা মেজাজি। তাই নিউজিল্যান্ডে চরম একপেশে আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদে স্ট্যাম্প লাথি মেরে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, রাগে পা ঘুরিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিলেন কাঁধ বরাবর। সেই ছবিটিকে আজ বিবেচনা করা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম একটি আইকনিক ছবি হিসেবে। হুইসপারিং ডেথের এই মূর্তি ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জরুরি ছিলো। যে কালো মানুষেরা যুগ যুগ ধরে নিগ্রহের শিকার, তাদের জন্য মাঠে ও মাঠের বাইরে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন ছিলো।

ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক ছবি

লংকানদের পরে বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে দীর্ঘসময় যে দেশটি হাসাহাসির পাত্র ছিলো সেটির নাম বাংলাদেশ। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পাওয়া এই দেশ ক্রিকেট খেলারই যোগ্য না, এদের কারনে বৈশ্বিক খেলার মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে এমন কথা গেল প্রায় সিকি শতাব্দী জুড়ে আমরা কম শুনিনি।

খেলার মান না হয় নতুন দলের বেলায় গড়ে উঠতে সময় লাগে, কিন্ত মানসিকতা! বাংলাদেশের বেলায় সেটাও ছিলো লজ্জার। ওস্তাদ আর সাগরেদের মতো। আন্তর্জাতিক খেলা হলে লড়াই দূরের কথা, ইমরান খান, কপিল দেব, রানাতুঙ্গাদের সাথে খেলতে পারছে এই খুশিতেই তামিম-সাকিবদের অগ্রজরা বিভোর থাকতেন। এমনকি পত্রিকাতেও নিজেরা ফলাও করে সাক্ষাতকারে তা বলতেন! খেলতে নামাই তাদের কাছে স্বপ্ন পূরণ। জেতা তো দূর, জেতার কথাও মনে আনার চিন্তা করতেন না। আম্পায়ারের ভুল ডিসিশন বা প্রতিপক্ষের টিপ্পনি সইতেন মাথা নিচু করে কিংবা ক্যাবলাকান্তের মতো অমলিন হাসি মুখে ঝুলিয়ে।  শোনা কথা, ইমরান খান নাকি একবার টসই করতে চাননি!

ক্রিকেট পাড়ায় বড় হওয়ার কারনে খেলোয়াড়দের দেখেছি, চিনতাম। মুশকো শরীরের এক ‘পেস’ বোলার ভারতের সাথে খেলে এসে পরেরদিন সেকি খুশি! আগের দিন ভদ্রলোক কি মারটাই না খেয়েছেন! সেই নব্বইয়ের দশকে রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি আটের বেশি করে। কিন্তু খুশির কারন কি? তিনি শচীনের উইকেট পেয়েছেন। শচীন তার কাছে প্রতিপক্ষ না, ছিলেন দেবতা। শচীনের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু বিপক্ষ তো বিপক্ষই। তা সে শচীন হোক কিংবা শেন ওয়ার্ন, তাতে যে বিহ্বল হওয়া যাবেনা, রানাতুঙ্গার মতো সেই মানসিকতাই ছিলোনা সে যুগের অধিকাংশ বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের।

পরিবর্তন এলো কিছু তরুন খেলোয়াড়ের হাতে। যারা গভীরভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন এই পরিবর্তন শুরু হয়েছিলো ২০০৬ সালের দিকে। সেসময় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে এক ঝাঁক মেধাবী তরুন খেলোয়াড় খেললেন। সেই দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালেরা তো পরবর্তীতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসটাই বদলে দিয়েছেন।

সাকিব, তামিমদের ক্রিকেটিং দক্ষতা এই দিন বদলের একটা বড় কারন হলেও এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারন ছিলো ‘নত না হওয়া’ মানসিকতার। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের যুবাদের সহজেই হারিয়ে সিরিজ জেতা আর বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে জোর গলায় বলা যে, আমরা জিততে যাচ্ছি। এই বিষয়গুলোই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাঁধাটাকে দূর করে দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলো।

মুশফিকরা সেবারে ট্রফি জেতেননি, কিন্ত সমবয়সী ‘বড় দলের’ যুবাদের তারা চোখে চোখ রেখে খেলেছিলেন। দেবতাজ্ঞানে নয়, বরং প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। সেই যুব বিশ্বকাপে খেলা ইংল্যান্ডের মইন আলী, এইউইন মরগান, পাকিস্তানের সরফরাজ আহমেদ, ভারতের রবীন্দ্র জাদেজা, রোহিত শর্মা আর চেতেশ্বর পুজারারা পরে নিজ নিজ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু তাদের পূর্বপূরুষদের মতো বাংলাদেশ দলটাকে এরা আর তাচ্ছিল্য করার সাহস পায়নি।

ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে নাকি সাহসীরা ভাগ্য গড়ে নেয় সে ভিন্ন এক বিতর্ক। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফলাফলের দিক দিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া খেলা ছিলো ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ। সেবারে ভারতকে হারিয়ে তাদের ছিটকে ফেলা আর দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো ছিলো চিরকাল ‘মিনোজ’দের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

এর দুই বছর আগেও তো টাইগারেরা অজেয় অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে, তবে এই দুটি ম্যাচকে এতো মহিমান্বিত করা কেন? কারন সেবারে টাইগারেরা জিতেছিল বলে কয়ে। সাকিবদের গুরু মাশরাফি ভারতের সাথে খেলার আগে দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন ‘ধরে দিবানি’। আর এই মন্ত্রটাই উসকে দেয় সাহসী হয়ে ওঠা মুশফিকদের। এরপর বাংলাদেশ বহু ম্যাচ হেরেছে, অনেকগুলো জিতেছেও। কিন্তু, খুব কম ম্যাচেই খেলার আগেই হেরে যায়নি। আর প্রতিপক্ষকে দেবতা ভাববার প্রশ্নই তো আর আসে না।

তবুও ‘মিনোজ’দের কোথায় যেন একটা ঘাটতি ছিলো। অনেকবার অন্যায়ের শিকার হয়েও মাঠে কখনোই খুব বেশি প্রতিবাদী ছিলেন না টাইগারেরা। তবে সেই ‘সাহসী প্রজন্মের’ সবচেয়ে সাহসী জন, সাকিব আল হাসান, আবারো নতুন এক বাঁকের জন্ম দিলেন। প্রতিপক্ষকে তো তার প্রজন্ম কখনোই দেবতা ভাবতো না, এবার তিনি দেখালেন যে সাদা কোট পরে আম্পায়ার অন্যায় করলেও প্রতিবাদ করা উচিত। রানাতুঙ্গার মতো, লয়েডের মতো, এমনকি সাহেব ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের মতো। না, তিনি অস্ট্রেলিয়ানদের মতো স্লেজিং করেননি, ইংল্যান্ডের মাইক গ্যাটিংয়ের মতো আম্পায়ারকে মারতে যাননি, তিনি কেবল দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আর স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, অন্যায় মানার বদলে খেলাটাই বরং ছেড়ে দেবো।

অন্যায়ের প্রতিবাদটুকু করা জরুরি নচেৎ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়

কারো কারো কাছে ব্যাপারটা ‘একটু বেশি বেশি’ ঠেকেছে। কিন্তু তারা আসলে ভিক্টোরিয়ান নীতিবাগীশগিরি কাটিয়ে উঠতে না পারা মানুষ। ভদ্রতার নাম করে অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ। তাদের মতো হলে, সাকিব আর বাংলাদেশ দল এখনও নব্বই দশকেই পড়ে থাকতো।

বহু বহু দিন আগে সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর সাগরেদকে নিয়ে একবার দিল্লিতে ইস্ট বেঙ্গলের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন আর সাগরেদকে বলেছিলেন, বেটা সিটি দে! সে বলে সিটি তো দিতে পারিনা, সৈয়দ সাব বলেছিলেন তালে আর ফুটবল দেখতে এসেছিস কেন হ্যাঁ, রবী ঠাকুরের ডাকঘর নাটক দেখতে গেলেই পারিস!

এই গল্পটা যেন গুরু আলী সাহেব এদের উদ্দেশ্যই লিখেছিলেন। এদের কথা শুনলে লীলা ব্যান্ডের গাওয়া গান ‘রাজায় কইসে …. ভাই আনন্দের আর সীমা নাই’ এর কথা মনে হয়। রাজার আদেশ মানায় আহা কি যে শান্তি!

দিনশেষে এরা লুজার আর সাকিব উইনার। আজকে সাকিব যে উদাহরণ তৈরি করলেন, এই রানাতুঙ্গাসুলভ ‘বেয়াদবি’ তাকে না হোক তার কোন উত্তরসূরীর হাতে বিশ্বজয়ের ট্রফিটা আনার শেষ বাধাটা দূর করলো। আর হ্যাঁ, এই জনপদে বাঘ আর সাপ দুইই খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি। এরা যুগযুগ ধরে কৃষককে সুরক্ষা দিয়েছে, আবার ভয়ও দেখিয়েছে প্রতিপক্ষকে। দক্ষিণ রায় আর মা মনসা উভয়েই তাই এই অঞ্চলের মানুষের শক্তির উৎস হয়ে থেকেছে, থাকবে। টাইগাররা দিক আরও অনেক কোবরা ড্যান্স। বাঘের থাবায় আর সাপের ছোবলে ছিন্নভিন্ন হোক সমস্ত প্রতিপক্ষ।