দার্শনিক, বিপ্লবী, সাংবাদিক, লেখক, ইতিহাসবিদ, ক্রীড়াপ্রেমিক এদুয়ার্দো গালিয়ানো ‘আধুনিক সভ্যতা’ আর আদিবাসীদের লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দিতেন ক্ষণে ক্ষণে। ‘ভূমিপুত্র’ গালিয়ানোর গল্পে তাই বারবার উঠে এসেছে প্রকৃতি রক্ষার লড়াইয়ে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের কথা। আর সব কিছুর সাথে তাই সাপও হয়ে উঠেছে তার লেখার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
সাপ এবং বজ্রপাত হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার আদিবাসীদের কাছে মঙ্গলের প্রতীক। এই দুইটি জিনিস তাদের ফসলের সুরক্ষা দেয়, ফসল হওয়ার আগমনী গান শোনায়। গ্যালিয়ানোর গল্পটা এদেশের জন্যও প্রযোজ্য। জলজঙ্গলের এই দেশের ইতিহাসটা কয়েক হাজার বছরের পুরনো আর এখানকার ভূমিপুত্ররা ল্যাটিনদের মতোই প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতো।
আর্যরা যখন এদেশ দখল করতে আসে তখন ভূমিপুত্রদের প্রতিরক্ষার অস্ত্র ছিলো সাপ। দুষ্ট আক্রমণকারীদের রুখতে তারা নাকি সাপ ছুঁড়ে দিতেন। তবে আমাজনের সন্তান ল্যাটিন আদিবাসীদের মতো প্রাচীন ‘বাংলা’ অঞ্চলের ভূমিপুত্ররাও আর্যদের কাছে শেষমেশ হেরে যায়।
তবে তার আগে এই লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা ছিলো দেবী মনসার। তিনি সাপের দেবী। তার ভাই বাসুকি হলেন নাগরাজ আর পুত্র আস্তিকা, একজন জ্ঞানী পুরুষ। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন আস্তিকা শব্দটি থেকেই ‘আস্তিক’ বা বিশ্বাসী শব্দটি এসেছে। এই আস্তিক একেশ্বরবাদ তো নয়ই এমনকি প্যাগানিস্ট আর্যদের সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। এটি প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন, প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস। প্রকৃতির গাছ, বাঘ, সাপ এমনকি পাথরগুলোও এর অংশ। তাদের সাথে সমমর্যাদা নিয়ে মানুষের বসবাসও এই বিশ্বাসের মূলকথা।
ঐতিহাসিকভাবেই যেটা হয়, দখলদার আর্যরা ভূমিপুত্রদের ভূমি আর দেশই কেবল দখল করে না, এর থেকেও বেশি আঘাত করে তাদের সংস্কৃতিকে। কখনো সেটি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, কখনো করে বিকৃত।
যে কারণে এনিমিজমের প্রতীকগুলো হয়ে যায় প্যাগানিস্টদের প্যান্থিয়ন বা দেবতাকুলের অংশ আর একেশ্বরবাদ আবার গ্রহণ করে প্যাগানিস্টদের প্রতীকগুলো। তবে গোল বাধে বেশি ‘ঝামেলা’ করা ‘অবাধ্য’ প্রতীক নিয়ে।
সাপ, এই প্রতীকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য। ফলে যেই সাপ ছিলো আদিবাসীদের সুরক্ষার প্রতীক, সেই সাপকে ডিমোনাইজ করা হয়। একে চিত্রিত করা হয় অশুভের প্রতীক হিসেবে, ক্ষতির কারণ হিসেবে।
সাপকে বলা হয় বেঈমানীর প্রতীক, অথচ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, আর্য শ্রেণিকে বারবার ছোবল মারার কারণেই তাদের এতো ভয়। মার্কসিস্ট দৃষ্টিতে বলা যায়, পুঁজিবাদী চাঁদ সওদাগরকে কামড়ে দেয়া মনসা আসলে প্রোলেতারিয়েতের প্রতীক।
আদি ইতিহাস থাক। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে আসা যাক। এখানে পূর্ব বাংলা এক অদ্বিতীয় জায়গায় পৌঁছেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত আর সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বাইরে বাংলাদেশই যে অন্ত্যজদের দেশ। এখানকার মানুষের পূর্বপুরুষেরা ছিলো চাষা, চন্ডাল। তাদের কেউ মুসলমান হয়েছে, কেউ হয়নি। তবে সেই আর্যদের আগমনের আগের থেকে যেই প্রতিবাদ সেই ধারা বজায় রেখেছে তাঁরা। ফলে বাঘের হুঙ্কার যেমন তাদের শক্তি দিয়েছে, সাপ তাদের অনার্য সংগীতের রণধ্বনি তুলেছে হিসহিস করে।
সাপকে নিয়ে এই অপপ্রচার তাই আসলে আর্য মানসিকতা, ব্রাহ্মণ্যবাদ, অনার্যদের ছোট করার চেষ্টা।
নাগিন ড্যন্স চলুক টাইগারেরা, থাবায় আর ছোবলে এলিটদের ভূপাতিত করে দাও হে ভূমিপুত্ররা