ক্রিকেটের ট্র্যাজিক এক গল্প থেকে আমরা কি শিক্ষা নেবো?

অল্প কিছুদিন আগে ২৫ বছর পূর্তি হলো একটি ঘটনার। দিনটা ছিল ১৯৯৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি। অস্ট্রেলিয়ার সুবিশাল সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তিন জাতি সিরিজের তিন-ম্যাচ ফাইনালের প্রথমটির খেলা চলছিল। বলা হয়, অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ডিন জোন্স সেদিন যা ঘটিয়ে ছিলেন সেটি নাকি ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুলগুলোর একটি।

কি সেটা? ক্রিকেট পরিসংখ্যানের খেলা, ফলে স্কোরবোর্ড দেখে সেটির উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত সমস্ত হলে এক্ষেত্রে কিন্তু হতাশ হতে হবে। স্কোরবোর্ড নামক ‘গাধা’টাকে জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে যে, অস্ট্রেলিয়া সেই খেলায় ২৪০ রান তাড়া করতে গিয়ে হেরে যায়। জোন্স ৩টি চারসহ মাত্র ১৩ রান করেন। স্টিভ ওয়াহ কিংবা ডেভিড বুনও সে ম্যাচে ১৫ আর ১৬ রান করেছিলেন, তবে জোন্সকেই কেন এতো দোষারোপ? আর এইরকম ত্রিদেশীয় ফাইনাল তো কম হলো না, তবে ঐটা নিয়ে এতোদিন পরেইবা এরকম স্মৃতিকাতরতা কেন?

জোন্সের একটা স্লেজিং নাকি এই স্মৃতিকাতরতার কারণ । হা হতোস্মি! স্লেজিং তো অস্ট্রেলিয়ানরা আকছারই করে! তাহলে এত উত্তেজনার কি আছে? আর, আদতে সেদিন ব্যাটসম্যান জোন্স স্লেজিংও করেননি। বোলারকে শুধু বলেছিলেন, ওহে, তোমার হাতের রিস্টব্যান্ডখানা খুলে ফেলো তো বাপু, আমার বড্ড অসুবিধা হচ্ছে। জোন্স ভেবেছিলেন এই কথা বললে বোলার ‘একটু’ রাগ করবে আর তার চোটে যদি লাইন লেন্থটা একটু হারিয়ে ফেলে।

এরপর যা হলো তা আর কহতব্য না! বোলারটির নাম ছিল কার্টলি এম্ব্রোস। হাসিখুশি, গান আর গিটারপাগল হলেও আকার আকৃতিতে দানবের মতো। আর সেটির চূড়ান্ত রুপ দেখলেন ডিন জোন্স।

গল্পটা বরং জোন্সের বয়ানেই শোনা যাক, ‘এম্ব্রোসকে আমি ব্যান্ডটা খুলে নিতে বলার পর দেখলাম সে রাগে কাঁপছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। হুট করে মনে হলো পুরো মাঠ যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। আর বোলার বোলিং মার্কে যাবার ঠিক আগে একজন দর্শক চিৎকার করে বললো, তুমি একটা ইডিয়ট জোন্স। এরপর এম্ব্রোস ওভারের বাকি তিনটা বল করলো কিন্তু আমি ডেলিভারিগুলোর একটাও চোখে দেখিনি। আমার জীবনে মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে জোরালো তিনটি বল ছিলো সেগুলো। আম্পায়ার যখন বললেন, ওভারের সমাপ্তি, আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর যখন কাটলো তখন দেখি নন স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা মার্ক টেইলর আমার দিকে অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলছে, এটা তুমি কি করলে? আমার দুইটা বাচ্চা আছে রে ভাই! আমার তখন মনে হচ্ছিলো ১১জন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, একজন অস্ট্রেলিয়ান আর মাঠভর্তি দর্শক মিলে আমাকে স্লেজিং করছে।‘

রিস্ট ব্যান্ড হাতে এম্ব্রোস

ঐ খেলায় এম্ব্রোস নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। পরের খেলাতেও অস্ট্রেলিয়াকে ১৪৭ রানে গুটিয়ে দিয়ে কাপ জিতে নেয় উইন্ডিজ। এখানেই শেষ না, ট্রাই সিরিজ শুরু হবার আগে যে উইন্ডিজ দল অস্ট্রেলিয়ার সাথে টেস্ট সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের একটি হারে আর আরেকটি জেতে, তারা পরের দুই ম্যাচ টানা জিতে এমনকি সেই সিরিজটাও জিতে নেয়।

এই ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলিং, এই ছিলো তাদের ফিয়ার ফ্যাক্টর। তিরিশ পেরোনো ক্রিকেট ভক্তরা সম্ভবত এমন সব খেলা দেখেই এই ভয়ংকর সুন্দর ক্যালিপসোর ভক্ত হয়েছেন।

কেবল ফাস্ট বোলিংই না, এ রকম ভয়ংকর সুন্দরের উদাহরণের পাশেই ছিলো ব্যাটিংয়ে নান্দনিকতা আর ব্রুটালিটির অপূর্ব সহাবস্থান।

যুগে যুগে যত ব্যাটসম্যানই আসুক ‘কিং ভিভ’ একজনই, কেননা দুনিয়ার তাবত ব্যাটসম্যান, তা সে ব্র্যাডম্যান হোক কিংবা টেন্ডুলকার, টেস্ট ম্যাচে ব্যাট করতে নামলে ফিল্ডার এগিয়ে আসে আর ভিভ নামলে তারা পড়িমড়ি করে দৌড়াতো ডিপে। সেই সত্তরের দশকে টর্নেডো গতির লিলি, থমসন, উইলিস, বোথাম, ইমরান, কপিলদের খেলতেও তিনি একবারও হেলমেট পড়েননি। চুইংগাম চাবানো ঠাণ্ডা মাথার ‘খুনি’ ছিলেন আমাদের আগের প্রজন্মের সবচেয়ে পপুলার ব্যাটসম্যান।

লারার হাতে যেন কথা কইতো উইলো

ব্রায়ান লারার চেয়ে নান্দনিক কোন ব্যাটসম্যান এ জগতে আসেনি বলেও দাবি করেন ক্রিকেট গেঁড়েরা। অস্ট্রেলিয়ার সাথে ১৫৩ রানের ইনিংসটার হাইলাইটস ইউটিউবে কয়েকশোতম বার দেখার পরও একই রকম অনুভূতি যখন হয়, তখন এই দাবির বিপক্ষে আসলে বলার কিছু থাকে না। উঁচু ব্যাকলিফট, ফুটওয়ার্ক, শেন ওয়ার্ন আর মুরালীর মতো দুনিয়া সেরা দুই বোলারকে যেভাবে তিনি খেলেছেনন সেগুলো আসলে লারা ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

একেবারের হাল আমলের ক্রিকেট ক্রেইজিরা হয়তো ‘সিক্স মেশিন’ ক্রিস গেইলের কথা বলবেন। আর টানা চার ছয় মেরে কার্লোস ব্রাফেটের যে বিশ্বজয় সেটা তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া ক্রিকেটে আর কারো পক্ষে করা সম্ভবই না।

ক্যালিপসো ছন্দের এই গল্প বলতে গেলে কয়েক খণ্ডের মহাভারত লিখতে হবে। সাইমন লেস্টার যার কিছুটা তুলে এনেছেন ‘ফায়ার ইন দ্যা ব্যাবিলন’ বইটাতে।

এম্ব্রোসের আগে কি করে গার্নার, হোল্ডিং, রবার্টস, ক্রফটরা চেরি হাতে আগুন ঝড়াতেন সেই গল্প পড়লে শিহরণ জাগে। কিভাবে একজন ফাইটার ম্যালকম মার্শাল আর লিডার ক্লাইভ লয়েড একটা দলকে অজেয় করে তোলেন সেই গল্প অনবদ্য। যদিও তাদেরও আগে ছিলেন গ্যারি সোবার্স, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম অলরাউন্ডার।

গল্পের গাছের শিকড়টা খুঁজতে গেলে পড়তে হয়, গত শতাব্দীর অন্যতম দার্শনিক সি এল আর জেমসের ‘বিয়ন্ড এ বাউন্ডারি’। কিভাবে ব্যাট আর বল হাতে কালো মানুষেরা সাদাদের জবাব দিয়েছিলো। পূর্বপুরুষের উপরে অমানুষিক নির্যাতন আর চাবুকপেটার বদলে কালো এই মানুষদের হাতে তলোয়ার আর গোলা হয়ে উঠতো উইলো কাঠের ব্যাট আর বল। কিভাবে কালো মানুষরা ক্রিকেটকে ঘিরে নিজের সম্মান অক্ষুন রাখে, মাথা তুলে দাড়ায়, কিভাবে একজন কালো মানুষ ফ্র্যাঙ্ক ওরেল সাদাদের হেজিমনি ভেঙ্গে হয়ে ওঠেন দলনেতা, হয়ে ওঠেন কালো মানুষের আত্মবিশ্বাস আর মুক্তির প্রতীক।

যদিও সে গল্পের করুণতম অধ্যায় শুরু হচ্ছে আজ। জেমস কিংবা ওরেল বেঁচে থাকলে এটাকে কিভাবে দেখতেন জানি না। ভিভ কিংবা লারাদের কাছে এ যেন বিধির বিধান।

আজ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় সারির দলগুলোর সাথে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে খেলবে। যে দলটি দুর্দমনীয়ভাবে প্রথম দুইটি বিশ্বকাপ জেতে আর তৃতীয় আসরে যাদের ফাইনালে হারাটা ছিলো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আপসেট তাদেরই এখন টেস্ট স্ট্যাটাস না পাওয়া, ক্রিকেট ঐতিহ্যবিহীন নেপাল, আরব আমিরাতের মতো দলগুলোর সাথে খেলতে হবে বাছাই পর্বে। সত্যি বলতে আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড কিংবা স্বাগতিক জিম্বাবুয়েকে টপকে বাছাই পর্ব পার হওয়ার সম্ভাবনাও তাদের প্রায় শূন্যের কোটায়। এতোটাই তলানিতে নেমেছে এখন উইন্ডিজ ক্রিকেট।

একটা চূড়ান্ত ব্যর্থ ক্রিকেট বোর্ড, স্থানীয় ক্রিকেটের ততোধিক দুর্বল অবকাঠামো। এককালে এম্ব্রোসের বাউন্সার আর পেসে মুখ পাংশু হয়ে যাওয়া জোন্স আর টেইলরের উত্তরসূরীদের কাছে এম্ব্রোসদের উত্তরসূরীরা এখন স্রেফ করুণার পাত্র।

বিশ্ব ক্রিকেটে উইন্ডিজের অর্জন-ইতিহাসের তুলনায় বাংলাদশের অর্জন বা ইতিহাস কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তবে দুইটি দলের মধ্যে মিল আছে ক্রিকেট নিয়ে জনতার আবেগের মাত্রায়।

ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা কম না বাংলার মাটিতেও

নিয়তির পরিহাসে উইন্ডিজের পতনের বিপরীতে দল হিসেবে বেশ খানিকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল আর মুশফিকুর রহিমদের মতো খেলোয়াড়দের কল্যানে বাংলাদেশ এখন এলিটদের খেলার অন্যতম এলিট দল, সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা দল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। উইন্ডিজের গৌরবময় ইতিহাসের মতো নিজেদের ঐতিহ্য নির্মানের আগেই বাংলাদেশের ক্রিকেটেও একই ব্যাধি দৃশ্যমান। জনপ্রিয়তায় দেশের এক নম্বর খেলা হলেও আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট আজও মানসম্মত না। বোর্ডের আচরণ অপেশাদার, কদাচিৎ বালখিল্য বলেও প্রতীয়মান হয়।

ঈশান কোণে বিপদজনক মেঘ দেখা যাচ্ছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে দেশটি এগিয়ে যাচ্ছিলো তাঁকে মাঝে মাঝেই দৌড়ানোর আগে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখছে সমর্থকরা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের এই চরম পতন আমাদের দুঃখ দেয়, কিন্তু আরও বেশি দেয় শিক্ষা। যত্নের অভাবে, অদক্ষতায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাটও যে ভিখারী হয়ে যায়।

আমরা কি এই গল্পটা থেকে কিছু শিখবো?