মানবতার শিল্পী বব মার্লে

‘Get up, stand up: stand up for your rights!

Get up, stand up: stand up for your rights!

Get up, stand up: stand up for your rights!

Get up, stand up: don’t give up the fight!’

—-[Get Up, Stand Up]

গানের কথাগুলো সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে এককভাবে যুদ্ধ ঘোষণাকারী শিল্পী রবার্ট নেসতা বব মার্লের, যিনি আমাদের কাছে বব মার্লে হিসেবেই পরিচিত। জ্যামাইকার পাসপোর্ট অফিস তার নামের কিছু অংশ কেটে দেয়ার পর তিনি হয়ে গিয়েছিলেন বব মার্লে। ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক রকস্টার, যিনি জ্যামাইকার রেগে, স্পার মতো লোক গানগুলোকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত ও জনপ্রিয় করেছেন। জ্যামাইকা নামক এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে আজ যে পুরো পৃথিবী চেনে, তার মূলে ছিলেন রাসতাফারিয়ান মতাদর্শের এই শিল্পী।

মার্লের জীবনে সঙ্গীত এসেছে শৈশবেই। তার ছোট্টবেলার বন্ধু ও গায়ক ডিগ্রি ওয়েসলি বলেছেন, ‘মার্লে কিন্তু কখনোই চমৎকার কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন না। তার ভয়েস ছিল (আমাদের মধ্যে) সব থেকে খারাপ। সেই খারাপ কন্ঠস্বরকে সুরেলা করতে অনেক সাধনা করতে হয়েছে তার। তবে তিনি সফলও হয়েছেন।’

The Wailers

স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ে সহপাঠীদের নিয়ে তৈরি করেন ‘দ্য ওয়েইলার্স’ নামের একটি ব্যান্ড। পরবর্তীতে যা বিশ্ব বিখ্যাত হয়। শুরু থেকেই গানের ব্যাপারে তারা ছিলেন খুবই সিরিয়াস। মঞ্চভীতি দূর করতে সে সময়ের স্কুল ছাত্ররা তাই রিহার্সাল করতেন কবরস্থানে।

গানে নিবেদিত বব মার্লেও তাই ধীরে ধীরে সবার মন জয় করে নেন। যেই সময়টায় তার সমবয়সীরা আনন্দ ফুর্তি করে সময় পার করছেন তখন তিনি সাধারণ মানুষদের কথা ভাবতেন। তার গানে মানুষের কথা, আধ্যাত্মিকতার কথা বলতেন। কথা বলতেন সবসময় ভ্রাতৃত্ববোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার। বিশ্বাস করতেন, মানুষের মনে ভালোবাসা ও গান প্রবেশ করাতে পারলেই ঘৃণা থেকে মুক্তি মিলবে। এই বিশ্বাসের কারণেই নিজের পুরো ক্যারিয়ারেই যুক্ত ছিলেন ‘রাসতাফারি’ আন্দোলনের সঙ্গে। রাসতাফারি, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় ভূখণ্ডে প্রচলিত এক সহজিয়া মতাদর্শ। রাসতাফারিরা বিশ্বাস করে কালো মানুষরাই ঈশ্বরের পছন্দের। পাশাপাশি ইথিওপিয়ার তৎকালীন সম্রাট হেইলে সেলাসিকেও যীশুর পুনরুজ্জীবিত অবতার হিসেবে বিশ্বাস করতেন রাসতাফারিয়ানরা। অনেকেই রাখেন জটাচুল, পবিত্র বলে গণ্য করেন গাঁজাকে।

মূলত, মার্লের বেড়ে ওঠা ছিল জ্যামাইকার শোষিত শ্রেণি-পেশার সমাজে। এই মানুষগুলো পুঁজিবাদ-বর্ণবাদ উভয়ের কারণেই শোষিত হত। মার্লের সংগীতে এই বিষয়টা বারংবার উঠে এসেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের সুখ-দুঃখের বিষয় সম্মিলিত সুরে কিছু গ্রামীণ গান করতো আফ্রিকা থেকে দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ হয়ে ক্যারিবিয়ানে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষগুলো। তাদের গানগুলোতে আফ্রিকার কৃষক ও শ্রমিকদের জীবনের গল্পগুলো সুরে সুরে উঠে আসতো। পরবর্তীতে রেগে নামে পরিচিত পায় এগুলোই। মার্লে এবং রেগে একই সুতোয় গাঁথা। মার্লেকে রেগে সঙ্গীতের অঘোষিত রাষ্ট্রদূত বলা হয় কারণ তিনিই রেগেকে বিশ্বসঙ্গীতের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন।

স্টেজ কাঁপাচ্ছেন বব মার্লে

১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া বব মার্লে ধরার বুকে খুব বেশি দিন মানবতার জয়গান গাইতে পারেননি। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সেই তাকে পৃথিবী ছেড়ে, কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে যেতে হয়। মার্লের সাবেক ব্যবসা পরিচালক কলিন লেস বলেন, ‘প্রায় চার হাজারেরও বেশি মানুষকে মার্লে দেখাশোনা করতেন। তাদের অভুক্ত না থাকা, প্রতিপালন করার ব্যবস্থা করেছিলেন মার্লে।’

মার্লের গল্পটা এক অতিবাস্তবতার গল্প। বিপ্লব, রেগে, গাঁজা, ফুটবলপ্রেমী, মানবতাবাদী ও কিংবদন্তী এক রকস্টারের গল্প। যার গান সাদা-কালো মানুষকে এক সাথে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। মার্লে নিজে প্রায় পাঁচশ গান লিখেছেন ও সুর করেছেন। তার গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘গেট আপ স্ট্যান্ড আপ’, ‘বাফেলো সোলজার’, ‘ওয়ান লাভ’ ও ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’। বিবিসি তার ‘ওয়ান লাভ’ গানটিকে শতাব্দীর সেরা গান নির্বাচিত করেছে। ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন ‘বব মার্লে অ্যান্ড দ্য ওয়েইলার্স’ অ্যালবামকে ‘বিশ শতকের সেরা অ্যালবাম’ নির্বাচিত করে ।

মানবতার জন্য আজীবন গান গেয়ে যাওয়া এই শিল্পীর দেখানো অ্যাক্টিভিজমের পথে অনেকেই আজ মানুষ নিয়ে কথা বলেন, মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেন।