২৫ জানুয়ারি ২০১৮। সকাল সাড়ে দশটা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের মঞ্চ প্রস্তুত। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজির শ আড়াই গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সাথে আছেন দুই বাংলার বিদ্বজ্জনরা, মিলনায়তন আলো করে। জমায়েতের উপলক্ষ্য- পঞ্চম আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন ২০১৭; যদিও মাস কয়েক পেছানোয় তারিখটা চলে এসেছে ২০১৮-তে।
আসতে বাকি কেবল একজন। তিনি এলেই শুরু হবে উদ্বোধনী আয়োজন। আরো আধা ঘণ্টা পর এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। সুস্থ নন। শরীর ভীষণ দুর্বল। হাঁটতে পারছিলেন না একা। তবুও হাজির তিনি। কারণ বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দ্বিবার্ষিক এই বিপুল আয়োজনে তিনি শামিল না হলে কি চলে। তাঁর হাতেই একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান যে রচিত হয়েছিল বাংলায়।
এরপর দ্রুতই শুরু হয়ে গেল উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। বিশাল মঞ্চের এমাথা-ওমাথা জুড়ে আলোকিত করে রাখলেন বিশ্বের নানা প্রান্তের বাংলা-সাধকগণ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করলেন ড. আনিুসজ্জামান। তিনি আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষৎ-এর সহসভাপতিও। মঞ্চ আলো করে ছিলেন পরিষদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও- সভাপতি অধ্যাপক দং ইউছেন (বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি, চীন), আরেক সহসভাপতি অধ্যাপক বরুণ কুমার চক্রবর্তী (এমেরিটাস অধ্যাপক, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত), সেক্রেটারি অধ্যাপক ড. রফিক উল্লাহ খান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং মহাসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্তী (টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ, জাপান)।
এছাড়াও ছিলেন বঙ্গবিদ্যা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা অধ্যাপক পবিত্র সরকার (সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত)। ছিলেন অধ্যাপক শিনকিচি তানিগুচি (টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ, জাপান) ও অধ্যাপক অভিজিৎ দাশগুপ্ত (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত)। ছিলেন বঙ্গবিদ্যার পঞ্চম আয়োজনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. খালেদ হোসাইন। সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামসহ আয়োজকদের আরো কয়েকজন প্রতিনিধি।
অতঃপর শুরু হলো পঞ্চম আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন ২০১৭। ২৫-২৮ জানুয়ারি, মোট চারদিনের আয়োজন হলেও, সম্মেলন চলেছে মূলত তিন দিন। প্রথম দিন একটি ও পরের দুই দিনে তিনটি করে মোট সাতটি একাডেমিক সেশন হয়েছে। প্রতি একাডেমিক সেশন আবার চলেছে আলাদা আলাদা সাতটি কক্ষে, আলাদা আলাদা সাতটি বিষয়ের উপরে। সেগুলোতে প্রবন্ধ পঠিত হয়েছে সাহিত্য, সাহিত্য সমালোচনা, তুলনামূলক সাহিত্য আলোচনা থেকে শুরু করে ভাষাতত্ত্ব, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, চলচ্চিত্র, মানবীবিদ্যা বা নারীবাদ, ধর্ম, দর্শন, অর্থনীতি, গণমাধ্যমবিদ্যা, নৃতত্ত্ববিদ্যার মতো সব বিষয়ের উপরে।
সব মিলিয়ে বিষয়-বৈচিত্র্যে সম্মেলনটিকে প্রকৃতই বঙ্গবিদ্যার সম্মেলন করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কেবল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্মেলনের মোড়কে তাকে আটকে রাখা হয়নি। এমনকি ভাষাও সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। বাংলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও গবেষণার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে ইংরেজিকেও। সাথে ২০টিরও বেশি দেশের বাংলা-সাধকদের অংশগ্রহণে জাহাঙ্গীরনগরে চার দিন ধরে বাংলা গবেষকদের যেন এক উৎসবই হয়ে গেল। সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারতের পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন চীন, জাপান, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলা-সাধকগণ।
বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষৎ-এর মহাসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্তী
সম্মেলনে তেমন লোক তো আর কম আসেননি।এই যেমন বাংলাদেশ থেকে ড. আনিসুজ্জামান, ড. রফিক উল্লাহ খান, ড. খালেদ হোসাইন ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিন, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী, অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল, অধ্যাপক রহমত আলী ও রবীন্দ্র চেয়ার মহুয়া মুখোপাধ্যায়; বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী ও অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফসার আহমেদ ও অধ্যাপক আহমেদ রেজা; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনসুর মুসা; রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শোয়াইব জিবরান।
সাথে ওপার বাংলা তথা ভারত থেকে পবিত্র সরকার, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, বরুণ কুমার চক্রবর্তী, অমিতাভ চক্রবর্তী ছাড়াও এসেছিলেন অনেকেই- অধ্যাপক সুবোধ কুমার যশ (উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়), অঞ্জন সেন (আসাম বিশ্ববিদ্যালয়), সুচরিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রমুখ।
বাংলাদেশ-ভারতের বাইরে আরও প্রায় ১৮টি দেশ থেকে এসেছিলেন ভিনভাষী বাংলা-সাধকগণ। তাদের মধ্যে চীনের দং ইউছেন ও জাপানের শিনকিচি তানিগুচি ছাড়াও আছেন জাপানেরই টোকিও উইনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের অধ্যাপক মাসাইকো তোগাওয়া ও সেন্ট এমরুজ ইউনিভার্সিটির কাজুও মিনামিদে, জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হান্স হার্ডার, চেক রিপাবলিকের চার্লস ইউনিভার্সিটির মার্টিন রিবেক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের হান-রুথ থম্পসন, রোমের পিনোজা ইউনিভার্সিটির ক্যারোলা এরোকা লোরিয়া প্রমুখ।
সব মিলিয়ে আয়োজনটা মহত তাতে সন্দেহ নেই। আয়োজকরা অব্যবস্থাপনা রুখতে না পারলেও, ভালোবাসা বিলানোর যে আশ্বাস উদ্বোধনীতে দিয়েছিলেন সেটি ঠিকই বাস্তবায়ন করেছেন। সঙ্গে সম্মেলনে জমায়েত হওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিদ্বজ্জনদের সাথে আলাপ-পরিচয় হওয়া, তাদের কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা উপদেশ-পরামর্শ শোনা, সব মিলিয়ে পাওয়ার পাল্লাও নিতান্ত হালকা থাকেনি।
তবে সে পাল্লায় ওজনে সবচেয়ে ভারি যে অনুষঙ্গটা উঠেছে, সেটা আবার ঠিক সম্মেলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। উঠেছে সম্মেলনের শেষ দিনে, সমাপনী অনুষ্ঠানের ঠিক আগ দিয়ে। আচমকাই জানা গেল অধ্যাপক ড. রফিক উল্লাহ খান বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্যে-শিক্ষকতায় তার বিপুল অবদানের কথা নাহয় নাই-বা স্মরণ করলাম, এতক্ষণ যে মহাযজ্ঞের গল্প বললাম, সেই বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনেরও তিনি অন্যতম কর্ণধার। যুক্ত আছেন শুরু থেকেই। বর্তমান কমিটিতে আছেন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি হিসেবেই। ফলে শওকত আলীর মৃত্যুসংবাদ বুকে নিয়ে সম্মেলনটা যে শোকগ্রস্ত আবহাওয়ায় শুরু হয়েছিল, শেষটা হলো ঠিক তার উল্টো প্রবণতায়। প্রাপ্তির এক আনন্দময় আবহাওয়ায়, এক ধরনের উৎসবমুখরতার আবহ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে।