২০০২ সাল। সেটা ছিল ভাষা আন্দোলনের সার্ধশত বার্ষিকীর বছর। সে উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে টিএসসিতে আয়োজিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর: চলচ্চিত্রে বাংলার মুখ শীর্ষক চলচ্চিত্র উৎসব। আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশসহ ঢাকার ১৪টি ধ্রুপদী বাংলা চলচ্চিত্র, সাথে বছর তিনেক আগে মুক্তি পাওয়া সাড়া জাগানো ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল উৎসবটিতে। এভাবেই যাত্রা শুরু করেছিল কেবল বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র নিয়ে আয়োজিত দেশের প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব, পরে যেটির নাম হয়েছে আমার ভাষার চলচ্চিত্র।
আয়োজকদের ইচ্ছা ছিল, এরপর থেকে প্রতি বছর শুধু বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র নিয়ে এই উৎসব আয়োজন করার। তা তারা করেও আসছে। কেবল দ্বিতীয় আসরে একটু গড়বড় হয়ে গেছিল। ফেব্রুয়ারির বদলে হয়েছিল মার্চে। স্বভাবেও খানিকটা বদল আনা হয়েছিল। এক সত্যজিতের ২১টি চলচ্চিত্র নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্র। তার পরের বছরই ঠিক করা হয়, বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের এই উৎসব আয়োজন করা হবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই।
তখনো অবশ্য নামটা নির্দিষ্ট করা যায়নি। ২০০৪-এ নাম দেয়া হলো বাংলা চলচ্চিত্র উৎসব, ২০০৫-এ বাংলার ছবি, ২০০৬-এ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ৫০ বছর। (১৯৫৬-তে মুক্তি পাওয়া মুখ ও মুখোশকে ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।) কিন্তু উৎসব যখন একটাই, নামও তো একটাই হওয়া উচিত। সেই নামটাও ঠিক হয়ে গেল ২০০৭-এ। ভীষণ মিষ্টি একটা নাম- আমার ভাষার চলচ্চিত্র। আর ২০১০-এ এসে উৎসবটির নাম আরো পূর্ণতা পেল। নামে ব্যবহৃত হতে শুরু করল বাংলা বছরও।
যা হোক, এটুকু মূল আলাপের মুখবন্ধ। আসল আলাপ এই উৎসেবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর ঠিকুজি-কুলুজি নিয়ে। এ বছর উৎসবটির ১৭তম আসর বসেছিল। এই সতের আসরে ইতিমধ্যেই কয়েক শ বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। মানে আর কিছু না হোক, উৎসবটিতে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের তালিকাটা ইতিমধ্যেই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য বাংলা চলচ্চিত্রের একটা সমৃদ্ধ দর্শন-সহায়িকা হয়ে উঠেছে। আপাতত আলাপ এই চলচ্চিত্রের তালিকা নিয়েই।
আগেই বলা হয়েছে, প্রথম আসরে দেখানো ১৫টি চলচ্চিত্রের ১৪টিই ছিল ঢাকার। অন্যটি ভারত-বাংলাদেশ বা কলকাতা-ঢাকা তথা টালিগঞ্জ-ঢালিউডের যৌথ প্রয়াস। দ্বিতীয় আসরে আবার সবগুলোই সত্যজিতের, মানে কলকাতার চলচ্চিত্র। এর পরের আসর থেকেই উৎসবটিতে সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর একটা উপস্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু হলো। ফলে সমান্তরালভাবে স্থান পেতে শুরু করলো দুই বাংলার চলচ্চিত্র।
আর এই সামগ্রিক উপস্থাপন শুরুর পর এক দুঃখজনক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হলো। এটা সত্যি যে কলকাতার চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্ট্রি ঢাকার চেয়ে ঢের পুরনো। এবং এটাও সত্যি যে ওপারের সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণালের পাশে দাঁড়ানোর মতো পরিচালক ঢাকায় খুব বেশি আসেননি। জহির রায়হান, আলমগীর কবির বা তারেক মাসুদ- সম্ভাবনাময় যারা ছিলেন, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাদের সবাইকেই আবার অকালে হারাতে হয়েছে। তারপরও সেরা চলচ্চিত্র বাছতে গিয়ে ঢাকায় আয়োজিত উৎসবে প্রায়ই ঢাকার চলচ্চিত্রই কম রাখতে হবে, সেটা আসলেই ভীষণ দুঃখজনক।
অবশ্য এটা ভেবে ভুল করার অবকাশ নেই যে সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল আমাদের নয়। এই তিন মহারথী নিঃসন্দেহে দুই বাংলার। এমনকি সত্যজিতের গুপী যখন গান গাইতে গাইতে উচ্চারণ করে আমরা বাংলাদেশের থেকে এলাম, কিংবা ঋত্বিকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-র নীলকান্ত যখন আবেগভরে বাংলাদেশ নামটি উচ্চারণ করে, তখন দুই বাংলার এক অখণ্ড প্রতিচ্ছবির আকাঙ্ক্ষাই ভেসে ওঠে।
কিন্তু অঙ্কের হিসাব বড় খটোমটো। সে হিসেবে উৎসবটির প্রথম যুগে আসলেই ঢাকার চলচ্চিত্র রাজত্ব করতে পারেনি। প্রথম দুই আসরের পরবর্তী এক দশক সময়ে, বাংলা ভাষার সেরা চলচ্চিত্রগুলো থেকে উৎসবের চলচ্চিত্রের তালিকা করতে গিয়ে, প্রায় অর্ধেক স্লটই ছেড়ে দিতে হতো কলকাতার চলচ্চিত্রের জন্য। কখনো আবার অর্ধেকেরও বেশি।
এটা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ বা ক্রোধের ব্যাপার নয়, তবে ঢাকার চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য অবশ্যই লজ্জাজনক একটি বিষয়। বিশেষ করে এই সময়ে সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র বাছতে গিয়ে, বিকল্প ধারার দু-একটা চলচ্চিত্র ছাড়া উৎসবে প্রদর্শনের মতো চলচ্চিত্র পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে যেত।
তবে পুরো গল্পটাই হতাশার নয়। সম্প্রতি সে দৃশ্যের বদল ঘটতে শুরু করেছে। অনেক দিন ধরেই এক ধরনের আশাবাদ ভেসে বেড়াচ্ছিল ঢাকার চলচ্চিত্রের বাতাসে। বিশেষ করে সফল আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা এক রকম বন্ধ করতে পারায়। এই আশার সুবাতাস ইন্ড্রাস্ট্রির প্রেক্ষিতে কতটা ফল দিতে শুরু করেছে, তা এখনো বিতর্কের বিষয় বটে। তবে সম্প্রতি বিকল্প ধারায় নির্মাণের সংখ্যা নিঃসন্দেহে অনেকখানিই বেড়েছে।
আর তারই প্রমাণ মিলছে আমার ভাষার চলচ্চিত্র-এর গত কয়েক আসরের চলচ্চিত্র তালিকায়। এই যেমন ২০১৫ সালের আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২১-এ ৭টি কলকাতার চলচ্চিত্রের বিপরীতে স্বল্পদৈর্ঘ্য-প্রামাণ্যচিত্র মিলিয়ে ঢাকার মোট ২৫টি চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে। পরের দুই বছরে এই অনুপাত যথাক্রমে ১৬ বনাম ৫ এবং ১৪ বনাম ৪। শেষ আসরে অবশ্য সাথে ৩টি যৌথপ্রযোজনার চলচ্চিত্রও ঠাঁই করে নিয়েছিল।
এ বছরের উৎসবের চলচ্চিত্র তালিকাও এই ধারাবাহিকতার স্বাক্ষ্য বহন করছে। ১২ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৪-এ প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে দেশি আমার ভাষার চলচ্চিত্রই ১৪টি। যৌথ প্রযোজনার দুটির একটি আবার আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা, যেটিকে মোটা দাগে ঢাকার চলচ্চিত্রই বলা চলে। অন্যটির জায়গা পাওয়া নিয়ে অবশ্য বিতর্ক করাই যায়। বিশেষ করে চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত একটি উৎসবে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমা দেখানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে বিতর্কটা বেশ দীর্ঘ এমনকি তিক্তও হতে পারে। বিপরীতে অবশ্য যুক্তি দেয়া যেতে পারে, আমার ভাষার চলচ্চিত্রের উপস্থাপনে সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক ঘরানার উপস্থিতি থাকাটা একেবারে অপ্রয়োজনীয়ও তো নয়।
সে অবশ্য অন্য আলাপ। মূল আলাপ হলো, ঢাকার চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার ফলে উৎসবের ২০টি চলচ্চিত্রের স্লটে খাঁটি কলকাতার চলচ্চিত্র রাখা গেছে মাত্র ৪টি। এর দুটিই আবার আবশ্যিক পছন্দ- সত্যজিৎ ও ঋত্বিকের চলচ্চিত্র। বাকি দুটির একটিকেও আবশ্যিক ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়- ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র। সাম্প্রতিক কোটায় স্থান পেয়েছে মাত্র একটি। বিপরীতে ২০১৭ সালের ঢাকার চলচ্চিত্রই প্রদর্শিত হয়েছে ৬টি। সাথে যৌথপ্রযোজনার একটি। আর ঢাকার ধ্রুপদী কোটায় আরো ৮টি।
সব মিলিয়ে তাই দেখা যাচ্ছে, দুই দশকের কাছাকাছি সময় পাড়ি দিয়ে অবশেষে ঢাকার এই চলচ্চিত্র উৎসবটিতে ঢাকার চলচ্চিত্রের রাজত্ব সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানে সোজা বাংলায়, এই দুই দশকের পথচলায় ঢাকার চলচ্চিত্র সত্যিই বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়েছে। সামনে চলচ্চিত্রের সোনালি দিন ফিরে আসছে, এখনই এমন মন্তব্য করাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। তবে ঢাকার চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদী হওয়াটা বোধহয় আর বাড়াবাড়ি হবে না।
আর সেই আশাবাদী অগ্রযাত্রায় আমার ভাষার চলচ্চিত্র নামের এই উৎসবটিরও নিঃসন্দেহে এক ধরনের অংশগ্রহণ আছে। বিশেষত গত দশকের শুরুতে ঢাকার চলচ্চিত্র নিয়ে সবার উন্নাসিক মনোবৃত্তির মাঝেও ঢাকার চলচ্চিত্রের স্বর্ণোজ্জ্বল গৌরব মনে করিয়ে দেয়া এবং পরবর্তীতে আশাবাদী অগ্রযাত্রাকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায় এই উৎসবটি সত্যিই কৃতিত্বের দাবিদার। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সংগঠন হয়েও এমন একটি উৎসব নিয়মিত আয়োজন জারি রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদকেও অভিনন্দন।
পরিশেষে প্রত্যাশা, এই আশাবাদী অগ্রযাত্রা বজায় থাকুক। ঢাকার চলচ্চিত্রের সুদিন ফের ফিরে আসুক। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।