দ্য ‘অরিজিনাল’ প্যাডম্যান

গল্পটার শুরু ১৯৯৮ সালে। ভারতের তামিলনাড়ুর কয়েম্বাটোরে নামের এক শহরে। অরুনাচালাম মুরুগানানথাম নামের এক মানুষের। মোটে ১৪ বছর বয়সেই পড়াশোনা শেষ না করেই যাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় জীবন যুদ্ধে। কাজ করেছেন মেশিনটুল অপারেটর, ওয়েল্ডিং, এমনকি সেলস এজেন্টের মতো পেশাতেও।

বিয়ে করেন ১৯৯৮ সালে, স্ত্রীর নাম শান্তি। বিয়ের পরই তিনি প্রথম বারের মতো লক্ষ্য করেন যে, তার স্ত্রী মাসিকের সময় ময়লা ন্যাকড়া-কাগজের মতো অস্বাস্থ্যকর বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করছেন স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে। ঘটনাটা তাকে অসম্ভব শঙ্কিত করে তোলে। বাজারে যেসব মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডের স্যানিটারি প্যাডগুলো পাওয়া যেতো তাদের সবগুলোই তার মতো মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের মানুষদের সামর্থ্যের বাইরে। তখন তিনি ভাবলেন, নিজেই কম খরচে স্যানিটারি প্যাড বানাবেন। সমাজের সকল শ্রেণির নারীরাই যেন সেটা ব্যবহার করতে পারেন. এমন উৎপাদন খরচেই তৈরি হবে অরুনাচালামের প্যাড। এই ছিলো লক্ষ্য। বিভিন্ন ধরনের কারখানার কাজের সাথে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী মন নিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজও শুরু করে দিলেন তিনি।

স্ত্রী শান্তি ও মেয়ে প্রীতির সাথে অরুণাচালাম

প্রতি মাসেই তৈরি করতেন নতুন নতুন নমুনা। প্রথমে শুধু তুলা আর কাপড় দিয়েই ডিজাইনগুলো তৈরি করতেন এবং গিনিপিগ বানাতেন নিজের স্ত্রীকে। প্রথম দিকে এই উদ্ধাবনী প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানালেও আস্তে আস্তে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে তার তুলকালাম সব কান্ডকে তার স্ত্রী আর পরিবারের অন্য সদস্যরা পাগলামি ভাবতে শুরু করে।

এতে কাজ আরও কঠিন হয়ে যায় অরুণাচালামের জন্য। কিন্তু থেমে থাকার পাত্র তিনি নন। শহরের এক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শরণাপন্ন হন। যদিও সঠিকভাবে ফিডব্যাক দিতে লজ্জা পেতেন অনেক ছাত্রীই। শেষমেশ নিরুপায় হয়ে অরুণাচালাম নিজেই নিজের বানানো ন্যাপকিন টেস্টের সিদ্ধান্ত নেন। এই পাগলামি দেখে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন শুধু তার মতিভ্রম কাটবে এই আশায়।

প্রায় ২ বছরের টানা গবেষণা শেষে তিনি কমার্শিয়াল প্যাডে কি ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তার হদিস পেলেন। পাইন কাঠের সেলুলোজ ফাইবার থেকে কমার্শিয়াল প্যাডগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয় যার দাম প্রায় ৩৫ মিলিয়ন রুপি।

নিজের তৈরি মেশিনের সামনে অরুণাচালাম

মুম্বাইয়ের এক সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকে মিললো কাঁচামালও। অনেক অনেক এবং অনেক ব্যর্থ প্রোটোটাইপের পর একসময় সময় মিললো সফলতাও। যে মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন তিনি চাচ্ছিলেন পেলেন ঠিক তাই। নিজে একটি মেশিনও তৈরি করে ফেললেন যা দিয়ে খুব সহজেই যে কেউ ঘরে বসেই তৈরি করতে পারবে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন। আর মেশিনটির দাম মাত্র ৬৫,০০০ রুপি!

‘ন্যাশনাল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ নিচ্ছেন অরুণাচালাম

২০০৬ সালে নিজের মেশিন নিয়ে পৌঁছান আইআইটি মাদ্রাজে। প্রযুক্তিগত বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য মতামতও নেন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। ‘Grassroots Technological Innovations Award’ জন্য রেজিস্টারও করে ফেলেন। এবং অ্যাওয়ার্ডটি জয় করেন।

এরপর গল্পটি শুধুই সফলতার। আস্তে আস্তে পুরো ভারতে ছড়িয়ে যায় অরুণাচালামের মেশিন। ভারতের ২৭টি প্রদেশে এখন পর্যন্ত তার ১৩০০ মেশিন বিক্রি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হয়েছে এই মেশিন। বাণিজ্যিকভাবে এই মেশিন বাজারে আনার জন্য করপোরেটরা অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিলেও, অরুণাচালাম নিজেই খুলেছেন ‘জয়শ্রী ইন্ডাস্ট্রিজ’।

ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত করছে অরুণাচালামকে

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের মাসিকের সময়টাকে নিরাপদ করার পাশাপাশি ‘সেলফ-হেল্প গ্রুপ’ নামের নারী সংগঠন মেশিনগুলো ব্যবহার করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও ফিরিয়ে এনেছে মধ্যবিত্ত ও গরিব নারীদের।

‘টেড-টক’ এর এক পর্বে Menstrual Man

২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যাক্তি’-র তালিকায় স্থান দেয়। ২০১৬ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। অরুণাচালামকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে সিনেমাও। ‘প্যাডম্যান’ নামের এই সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অক্ষয় কুমার। এই মাসের ২৫ তারিখ মুক্তি পাবে সিনেমাটি। অথচ কিছু বছর আগেও এই অরুণাচালাম ছিলেন স্রেফ সাধারণ একজন মানুষ এবং কিছু বছর আগেও পুরো ভারতে মাত্র ১২% নারী স্বাস্থ্যকর স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতো। কিন্তু অরুণাচালাম একাই পালটে দিয়েছেন পুরো চিত্র। তাই সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যানদের ভিড়ে এই অসাধারণ অরুণাচালামও কিন্তু সমাজ পরিবর্তনে কোন অংশে কম সুপারহিরো নন।