বাংলা জীবনমুখী গানে বোর্ডিং ফেরত রকস্টার হিসেবে খ্যাত একজনই, যিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মৃণাল সেনের সহকারী হিসেবে। একজন সফল গায়কের পাশাপাশি সফল গীতিকার, সুরকার, সফল অভিনেতা এবং সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে ছোট-বড় দু’ পর্দাতেই হাজির থেকেছেন। শুধু পর্দায়ই নয়, নিজের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব দিয়ে, নিজের মোহনীয় আর্কষণী ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করে রেখেছেন অঞ্জন দত্ত।
অঞ্জন দত্তের গান, সিনেমা এমনকি লেখালেখির সবচেয়ে বড় গুন স্বাতন্ত্রে। যা শুধু অঞ্জন দত্তের একান্তই নিজস্ব। এবং শুধুমাত্র অঞ্জন দত্তকেই যেন এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে মানায়। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি একদমই পলিটিক্যালি কারেক্ট নন, সবসময় শুধু নিজের ভালোলাগাকে, নিজের সন্তুষ্টিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।
জীবনমুখী গান গেয়ে অঞ্জনের সঙ্গীতে আত্মপ্রকাশ। নব্বইয়ের দশকে ‘বেলা বোস’, ‘রঞ্জনা’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, ‘আলীবাবা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ এই গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা তেমন বাংলায়। শুধু তাই নয় ‘২৪৪১১৩৯’ এই নম্বরটা সবার মনে গভীরভাবে গেঁথেও গিয়েছে। অসংখ্য মানুষতো এই নম্বরে ফোন দিয়ে বেলা বোসের খোঁজ করেছে। পাড়ার হিরো দাদাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রঞ্জনার পিছু ছেড়েছে এমন তরুণের সংখ্যাও তো কম নয়। এইসব গান শুধু গানই ছিল না, ছিল সে সময়ের এক একটা বিশাল গল্পের সমাহার। এই গানগুলোর সাথে সাথেই আমরা বড় হয়ে উঠেছি।
বছর পেরোলে একটি করে অ্যালবাম বিয়োনোর ধারা অঞ্জন দত্ত একদমই মানেননি। ১৯৯৪ সালের ‘শুনতে কি চাও?’ একক অ্যালবাম দিয়ে শুরু করলেও তার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ‘রং পেন্সিল’ একক অ্যালবাম করার পর দীর্ঘ বিরতি নিয়েছেন। বিরতির পর ফেরেন ২০১৪ সালে, ‘ঊনষাট’ একক অ্যালবামটি নিয়ে।
নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হতে চেয়েছিলেন তাই ছেড়েছেন ছকে বাঁধা চাকরি, স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। মায়ের বুনে দেওয়া সোয়েটার বিক্রি করেছেন বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু আপোষে তিনি যাননি, নিজের জীবনকে বিকিয়ে দেননি।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের কাছে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি। অভিনয় দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবেও সাফল্যের দৃষ্টান্ত গড়েছেন। ১৯৯৮ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘বড়দিন’ দিয়ে তার পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও পরে নির্মাণ করেছেন ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র ‘বো ব্যারাক ফরএভার’। মাতৃভাষা বাংলায় ‘দ্যা বং কানেকশন’, ‘ম্যাডলি বাঙ্গালী’, ‘ব্যোমকেশ বক্সী’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’, ‘আবার ব্যোমকেশ’, ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’, ‘গণেশ টকিজ’, এবং ‘ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’। ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ সিনেমায় ব্যক্তি অঞ্জনের জীবনের হদিস মেলে অপূর্ব গল্প কথনে।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বর্তমানে অঞ্জন দত্তের খ্যাতি অনেককেই ভুলিয়ে দিয়েছি বিকল্পধারার অভিনেতা হিসেবে এককালে তার ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তাকে। মৃণাল সেন বাদেও বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ এবং হালের সৃজিত মুখার্জির চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এমন একজন ‘দত্ত, অঞ্জন দত্ত’ যুগ যুগ আমাদের মাঝে থাকবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।