ক্রিস্টোফার নোলান। সিনেমাপ্রেমীদের সুপরিচিততম নাম। প্রতি বছর তার পরিচালিত সিনেমার মুক্তির জন্য শুধু হলিউডই নয়, অপেক্ষা করে পুরো দুনিয়াই। একই সাথে ব্যবসাসফল ও সমালোচকদের টেবিলে সমান প্রশংসিত সিনেমার জন্ম দিতে সক্ষম এমন ক’জনই বা আছেন বলুন! তার পরিচালনায় অনেকেরই অস্কার ভাগ্য খুললেও কিন্তু এখনো অধরাই রয়ে গেছে নোলানের নিজের জন্য, একান্ত একটি সোনালি ট্রফি।
১৯৯৮ সালে ‘Following’ দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা শুরু। তখনো নোলানকে প্রায় কেউ চেনেই না। লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় মাত্র হাজার ছয়েক ডলার বাজেটে সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন তিনি। কোন প্রযোজক জোটানোর তার পক্ষে সেই সময় সম্ভব হয়নি। নিজেই ছিলেন ক্যামেরার পেছনে ও পরিচালনায়। এমনকি ছবিটির এডিটিংও করেছিলেন নিজেই। সিনেমাটি ছিলো মাত্র ৭০ মিনিটের। প্রচুর রিহার্সাল করে শ্যুটিং-এ যেতেন যেন বেশি ফিল্ম খরচ না হয়। এক বা দুই টেকেই ধারণ করা সে সিনেমায় এমনকি স্টুডিও লাইটিংও ছিলো না। খরচ কমাতে পুরো ছবিই শ্যুট করেছেন প্রাকৃতিক আলোয়। এক বছর ধরে সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে শ্যুটিং করে নোলান ‘Following’র কাজ শেষ করেছিলেন।
তবে ছবিটি সমালোচকদের চোখ এড়ায়নি। অনেকেই তার প্রথম কাজেই আলফ্রেড হিচকককে খুঁজে পেতে শুরু করেন। ফলাফল হিসেবে আর কখনো প্রযোজকের পিছনে ছুটতে হয়নি নোলানের। প্রযোজকরাই আসতে শুরু করেন তার কাছে। দ্বিতীয় ছবি ‘Memento’ মুক্তি পায় ২০০০ সালে। দর্শক-সমালোচক সবার কাছেই নোলান তার নন-লিনিয়ার ধাঁচে গল্প বলার ধরনের জন্য প্রশংসিত হন। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম অস্কার নমিনেশনও বাগিয়ে নেন ক্রিস্টোফার নোলান। ‘Best Screenplay’ ক্যাটাগরিতে তিনি ও তার ভাই Jonathan Nolan দু’জন একই সাথে মনোনীত হন। কিন্তু অস্কারটা পাওয়া হয়নি তাদের সে যাত্রায়।
২০০৫ সালে তিনি তার বিখ্যাত ব্যাটম্যান ট্রিলজির প্রথম সিনেমাটি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন। ‘Batman Begins’ নামের এই সিনেমায় কমিকপ্রেমীরা চিরপরিচিত কঠোর ব্যাটম্যানকে খুঁজে পায় ক্রিশ্চিয়ান বেল-এর অভিনয়ে। নোলানের এই সিনেমাটি একটি অস্কার নমিনেশনও পায় সেবছর। নমিনেশনটি ছিলো Best Achievement in Cinematography ক্যাটাগরিতে। নোলানের বেশিরভাগ সিনেমায় সিনেম্যাটোগ্রাফির কাজ করা Wally Pfister অবশ্য সেবারে জিততে পারেননি অস্কার।
২০০৬ সালে নোলানের পরিচালনায় ড্রামা-সাইফাই ধারার ‘The Prestige’ প্রচুর দর্শক জনপ্রিয়তা পায়। হিউ জ্যাকম্যান ও ক্রিশ্চিয়ান বেল অভিনয় করেন দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী জাদুকরের ভূমিকায়। তাদের মধ্যের নীরব প্রতিযোগিতাই ছিল সিনেমার মূল গল্প। এই ছবিটিরও জুটেছিল দুটো অস্কার নমিনেশন। সিনেম্যাটোগ্রাফি ও আর্ট ডিরেকশনে।
২০০৮ সালে নোলান বক্স অফিস কাঁপিয়ে দেন ‘The Dark Knight’ নামের ব্যাটম্যান ট্রিলজির ২য় কিস্তি দিয়ে। সর্বকালের সেরা সুপারহিরো সিনেমাগুলোর মধ্যে যার নাম সবসময় উপরেই থাকবে। জোকার চরিত্রে হিথ লেজারের অসাধারণ অভিনয় মন কেড়ে নিয়েছিলো সকলের। সেবছর ৮টি অস্কার নমিনেশন পায় ‘The Dark Knight’। হিথ লেজার ‘Best Actor in a Supporting Role’ ক্যাটাগরিতে মরনোত্তর অস্কার জয় করেন। সাউন্ড এডিটিং-এর অস্কারটিও সেবছর এই সিনেমার দখলেই যায়। যদিও নোলানের ভাগ্যে সেই লবডঙ্কা।
২০১০ সালে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে সিনেমা করেন নোলান। ‘Inception’ নামের এই সিনেমাটি বক্স অফিস তো মাত করেই, সেই সাথে জিতে নেয় ৪টি অস্কারও। এই সিনেমাটির জন্য নোলান নিজে দু’টো নমিনেশন পেলেও, সেবছরও তার অস্কার দুর্ভাগ্য কাটেনি।
২০১৪ সালে অ্যাডভেঞ্চার-সাইফাই ধাঁচের সিনেমা ‘Interstellar’ পরিচালনা করেন তিনি। প্রায় ৩ ঘন্টার এই সিনেমাটি দেখে অনেক সাই-ফাই বিমুখী সমালোচকও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। ৫টি নমিনেশন পেলেও সিনেমাটি অস্কার জেতে শুধুমাত্র একটি ক্যাটাগরিতে। এবং এবারও নোলানের অস্কার ভাগ্য তার দিকে মুখ ফিরে চায়নি।
এভাবে বারবার অস্কার নোলানের হাতের খুব কাছে এসেও অধরাই থেকে গেছে। যদিও কপালে জুটেছে অনেকগুলো নমিনেশন। তবে যে পরিচয়ে নোলান সবচেয়ে বেশি পরিচিত; সিনেমা পরিচালনা, সেই ক্যাটাগরিতেই কখনো মনোনয়নই পাননি তিনি। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো ‘Best Achievement in Directing’-এই ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেলেন ক্রিস্টোফার নোলান নিজের সর্বশেষ ছবি ‘Dunkirk’ এর জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি এই সিনেমাটি মূলত ‘Dunkirk Evacuation’ এর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। এবারে ৮টি নমিনেশন পেয়েছে সিনেমাটি। তাই ফ্যানেদের ভাবনা, নোলান কি পারবেন এবার? নাকি আবারও নমিনেশন পর্যন্ত এসেই আটকে যাবে তার অস্কার ভাগ্য?
সেই উত্তরটা জানতে মার্চের ৪ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর যে কিছুই করার নেই দর্শকদের।