গহীন বালুচর: পুরোনো গল্পের দারুণ প্যাকেজিং!

দিনের সাথে তাল মিলিয়ে চলচ্চিত্র বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। এমনকী মূলধারার চলচ্চিত্রেও দেখা যাচ্ছে দিন বদলের টান। নতুন কাহিনি, নতুন ভাবনা, এমনকি নতুন ধরনের চলচ্চিত্রের সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে সিনেদর্শকরা। কিন্তু আদতে কি সেই সব বৈচিত্র্য চলচ্চিত্রের মূল ধারার ফর্মুলাকে খুব একটা বদলাতে পেরেছে বা পারছে?

উত্তরটা অবশ্যই নেতিবাচক। মূল ধারার চলচ্চিত্র আসলে কিছু নির্দিষ্ট ফর্মুলাতেই আটকে আছে বা থাকছে। কিন্তু সেই ফর্মুলার উপরের প্রলেপ অর্থাৎ প্যাকেজিং দিন দিন বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। তাতে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন উপাদান; কোনোটা সময়ের প্রয়োজনে, কোনোটা কাহিনির প্রয়োজনে, কোনোটা বক্তব্যের প্রয়োজনে, কোনোটা উপস্থাপনে চমক নয়তো চটুলতার ব্যাকুলতায়, আবার কোনোটা হয়তো পরিচালকের ইচ্ছায়।

এই ফর্মুলা মানার ব্যাপারটা ভালো না মন্দ, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তবে তাদেরকে উপেক্ষা করাটা সহজ নয়। বক্স অফিসে সাফল্যের সাথে এগুলোর যোগাযোগ পরীক্ষিত সত্য কিনা! তবে বক্স অফিস সাফল্যের জন্য ফর্মুলার উপরে যথার্থ প্রলেপ দেওয়াটাও এখন জরুরি।

 

এমনই একটা পরীক্ষিত ফর্মুলা হলো দুই বিবাদমান গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষ নিয়ে সিনেমা বানানো। ফর্মুলাটাও বেশ সহজ- দুইটি পরস্পর বিবাদমান গোষ্ঠী থাকবে, তাদের মধ্যকার তিক্ত অতীত হবে কাহিনির মূল ভিত্তি। তার সাথে সাব-প্লট হিসেবে একটা প্রেমকাহিনি জুড়ে দেওয়া হবে। এই প্রেমের পূর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে দুই পক্ষের বিবাদ। এই দুই কাহিনির পূর্ণতার যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব, তার ফলে পুরো সিনেমার কাহিনিটাকে বেশ একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও ফেলে দেওয়া যাবে। সেই শেক্সপিয়ারের কাল থেকেই এ এক পরীক্ষিত ফর্মুলা। মোটা দাগের এই ফর্মুলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের জন্য বেশ জনপ্রিয়। ফর্মুলা মেনে সেই পুরনো মদ নিত্যনতুন বোতলে ঢেলে প্রতি বছরই হলিউড-বলিউডে অজস্র সিনেমা তৈরি হচ্ছে। গহীন বালুচর-এর কাহিনিও সেই একই পুরোনো মদের মতো। তবে বোতলটা বেশ সুশ্রী, সুন্দর। এমন সুন্দর নতুন বোতল ঢাকার মূলধারার চলচ্চিত্রে তেমন একটা দেখা যায় না।

 

মোটা দাগে কাহিনিটা মূলত একটা দ্বন্দ্ব আর একটা প্রেমের গল্প। দ্বন্দ্বটা দুই গ্রামের মধ্যে, দ্বন্দ্বের বিষয় একটা চর- কালার চর। এই চর নিয়ে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষের ইতিহাসও বেশ পুরনো। তাতে ক্ষয়ক্ষতি আছে দুই পক্ষেরই। তবে শেষবারে জয় হয়েছিল নেতিবাচক পক্ষের। সেই চরটাই যখন আবার জেগে ওঠে, আবারও দুই গ্রামের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অবশ্য সমান্তরালে প্রেমের গল্পটা দুই পক্ষের মধ্যেকার নয়, যদিও তাতে দুই পক্ষের স্বার্থও জড়িয়ে পরে। তখন প্রেমটা নিজেই হয়ে ওঠে এক ত্রিভুজ প্রেম। সাথে দুই গ্রামের দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে বেশ একটা জটাজাল তৈরি করেই সিনেমাটা পরিণতির দিকে এগোতে থাকে।

কালার চর নিয়ে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষের ইতিহাস বেশ পুরোনো

বোতল সুন্দর থুক্কু প্যাকেজিং দারুণ বলার অন্তত তিনটি কারণ এই সিনেমার কাহিনির মধ্যে নিহিত আছে। প্রথমত, কাহিনিতে দুইটি পৃথক গল্প বলা হলেও, গল্পদুটি শেষে গিয়ে ঠিকঠাক এক সুতোয় গেঁথেছে। দ্বিতীয়ত, কাহিনিটা যদিও অ্যারিস্টোটলীয় ফর্মুলার প্রারম্ভ-প্রবাহ-উৎকর্ষ-গ্রন্থিমোচনের নিয়ম মেনে এগিয়েছে, কিন্তু কখনোই বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি। বরং সবসময়ই এক ধরনের আগ্রহ ধরে রাখা গেছে।

 

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত তৃতীয় কারণটি। সাধারণত এই ফর্মুলার প্রয়োগ করতে গিয়ে ঢাকার চলচ্চিত্রে এমন সব সমাজ ও সমাজ-বাস্তবতা দেখানো হয়, যেগুলোর সাথে আমাদের সমাজের দূরতম যোগাযোগ স্থাপন করাও দুষ্কর। বলা বাহুল্য, সেগুলোর কাহিনি সাধারণত ওই ফর্মুলা মেনে নির্মাণ না করে বরং এই ফর্মুলা মেনে নির্মাণ করা ভিনদেশি সিনেমার কাহিনি থেকেই নেওয়া হয়। আর তাতেই এই দূরত্বের উদ্ভব। গহীন বালুচর-এ অবশ্য শুধু ফর্মুলাটিই নেয়া হয়েছে। তাকে ভিত্তি করে কাহিনি স্থাপন করা হয়েছে আমাদের দেশের কোনো এক নদীর দুই পাড়ের দুই গ্রাম আর তার মাঝে জেগে ওঠা এক চরকে কেন্দ্র করে। ফলে দূরত্বের নয়, তৈরি হয়েছে নৈকট্যের আস্বাদ।

প্রেমের গল্পটা দুই পক্ষের মধ্যকার নয়, যদিও তাতে দুই পক্ষের স্বার্থও জড়িয়ে পরে

এই নৈকট্যের মধ্যে আবার খানিকটা দূরত্বও আছে। চলচ্চিত্রটিতে চরাঞ্চলের উপস্থাপনটা ঠিক রিয়েলিস্টিক নয়, অনেকটাই সিনেমাটিক। ব্যাপারটাকে এভাবেও বলা যেতে পারে, চরাঞ্চলের গল্পটাকে নিয়ে এক ধরনের ফ্যান্টাসি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে দৃশ্যগত সৌন্দর্য বা ভিজুয়াল বিউটি নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। ফলে চরিত্রগুলোর মেকআপ-কস্টিউম কিংবা তাদের নাচ-গান বা আচার-আচরণ পুরোপুরি চরাঞ্চলের মানুষের মতো থাকেনি। তবে সেগুলো আবার অনেকটাই দৃষ্টিসুখকর হয়ে উঠেছে। মোটা দাগে এই দুই প্রচেষ্টায় পরিচালক শতভাগ সফল না হলেও, সমসাময়িকতার বিচারে ভালো নম্বর ঠিকই পাবেন।

চলচ্চিত্রটিতে দৃশ্যগত সৌন্দর্য বা ভিজুয়াল বিউটি নির্মাণের আকাঙ্ক্ষাও লক্ষ্য করার মতো

শুধু এই দুই প্রচেষ্টাতেই নয়, সমসাময়িকতার বিচারে গেলে ভালো নম্বর উঠেছে সিনেমার প্রায় সব কারিগরি দিকগুলোতেই। আর এসবেরই মিলিত ফসল একটা সুন্দর নতুন ঝাঁ-চকচকে বোতল মানে প্যাকেজিং। ফলে মদটুকু পুরনো হলেও তাতে খুব একটা আপত্তি করা চলে না। বিশেষত অতি সাম্প্রতিক কিছু প্রচেষ্টা বাদ দিলে, ঢাকার চলচ্চিত্রে যেখানে পুরোনো বোতলই বিকোয়, সেখানে এমন একটা নতুন বোতলে পুরনো ফর্মুলা চাখতে রসিকদের ভালোই লাগার কথা।