পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনের ইতিহাস। পরিবর্তনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, কারণ পরিবর্তনের মধ্যেই জন্ম হয় নতুনের। শিল্পের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বা নতুনত্বের জন্ম সহজ ও স্বাভাবিক। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে নতুনত্ব মানেই অনেক সময় পাশ্চাত্যের সাথে মিশেগিয়ে নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা হয়ে উঠছে একমাত্র প্রবণতা। যেই প্রবণতা কিন্তু সংস্কৃতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। আধুনিকতার জন্ম যখন ইউরোপে হয়েছিল তখন সদ্য সদ্য ইউরোপ ঔপনিবেশিকতার স্বাদকে হজম করেছে। এই কারণে সমগ্র বিশ্ব থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে আশা ব্রাত্যজনের শিল্পকে অর্থাৎ লোক ও আদিম শিল্পকে তার ফরমাল বিউটি বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সমসাময়িক সময়ে আবার নব্য জাতিয়তাবাদের বিকাশের কারনে ইউরোপ ধর্ম থেকে তার শিল্পকে মুক্ত করে নতুনকে জানার প্রতি আগ্রহী হয়। এই নতুনকে তারা খুঁজে পেয়েছিল আফ্রিকার মুখোশে, ইরানের কার্পেট অথবা জাপানের কাঠখোদাই চিত্রে। ইউরোপের শিল্পের আধুনিকতা এক্ষেত্রে এতই ভাসাভাসা ছিল যে এই শিল্পবস্তুগুলোর প্রসঙ্গকে ব্যাতিরেখেই শিল্পীরা শুধু এদের রঙ, রেখা ও আকারের সৌন্দর্যেই বিভোর ছিল। কিন্তু আমাদের প্রাসঙ্গিকতায় যখন রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিরা বিশ শতকের আধুনিকতাকে পরিচয় করাতে চাইলো তখন তিনি শান্তিনিকেতনের রূপকল্পনায় নিবিষ্ট হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার আধুনিকতার সাথে পাশ্চত্যের আধুনিকতার প্রাসঙ্গিক পার্থক্য। যে ঐতিহ্যহীন সমাজে ইউরোপের তৎকালীন আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিল এমন সমাজ আমাদের নয়। আমাদের সমাজ ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ হলেও এই সমাজ আবার রক্ষণশীল এবং একই সাথে ঔপনিবেশের তাবেদারিতে নিমগ্ন। এমন বাস্তবতায় তিনি আধুনিকতার আদর্শ খুজঁতে গিয়েছিলেন বীরভূমে। যে বিরভূমে আছে এই মাটির আদি ভূমিপুত্র সাওতালরা। যে সাওতালরা ছিল ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতামুক্ত, যাদের মধ্যে হিন্দু সমাজের গোড়ামী নেই, নেই ঔপনিবেশিক সমাজের প্রভূর পদলেহন, নেই পাশ্চাত্যভিমুখিতা। যা আছে তা হলো নির্মল প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার সহজ বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথ এই বাস্তবতাকে বুঝতে পেরেছিলেন আর পেরেছিলেন বলে অবনীন্দ্রনাথে সচেতন স্বদেশীয়ানার থেকেও আগ্রহী হয়েছিলেন স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক সচেতনতার। যে সচেতনায় ঐতিহ্যও থাকবে, থাকবে প্রকৃতিও।
শিল্পীর সাথে ঐতিহ্য ও প্রকৃতির এই সহজ বোঝাপড়ার মধ্যে সম্প্রতি আয়োজিত হয়েছে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে পৃথিবীর প্রায় দশটি দেশের থেকে আসা শিল্পীদের মিলনমেলা। ‘নেরেটিভ মুভমেন্ট’ নামের একটি আর্ট অর্গানাইজেশান গত কয়েকবছর ধরে নানা শিল্পকর্মকান্ড পরিচালনা করছে ভারতে ও ভারতের বাইরে। তাদের মূল ভাবনা স্থানীয় ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে বিশ্বশিল্পসংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন। পদ্মবিভূষণ শিল্পী কে জি সুব্রামনিয়ান এর ¯স্নেহধন্য এই আর্ট অর্গানাইজেশানের নামও তাঁর দেওয়া। আর্ট এক্সিবিশন ও আর্ট রেসিডেন্সি ছাড়াও শিল্পসম্পর্কিত নানা কর্মকান্ড আয়োজন এই অর্গানাইজেশান স্বাভাবিক কর্মকান্ড। অক্টোবরের ত্রিশ তারিখ থেকে নভেম্বর এর আট তারিখ পর্যন্ত এই ‘নেরেটিভ মুভমেন্ট’ আয়োজন করে ইন্টারনেশনাল আর্টিস্ট রেসিডেন্সি প্রোগামের যার নাম ‘গোল্ডেন থ্রেড’। আর্ট রেসিডেন্সি বর্তমান বিশ্বের একটি জনপ্রিয় শিল্পপ্রবণতা। সাধারণত এক বা একধিক শিল্পী অথবা গুচ্ছ শিল্পী একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে শিল্প রচনার মাধ্যমে শিল্পঅভিজ্ঞতা আদান প্রদান করে এমন রেসিডেন্সিতে। বিরভূমের যে জায়গায় এই আর্টিষ্ট রেসিডেন্সির আয়োজন হয় তার নাম রাজার পুকুর। রাজার পুকুর জায়গাটির একদিকে ছিল সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর অন্যদিকে অল্প ব্যাবধানে ছিল নিমডাঙা সাওতাঁল পল্লী। প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের যেন আদর্শ এক সংঙ্গমস্থল ছিল এই জায়গাটি। যে ভাবনায় নেরেটিভ মুভমেন্ট আর্ট অর্গানাইজেশান এই রেসিডেন্সির আয়োজন করেছিল তার ভীষনভাবে যর্থাৎ এই রাজারপুকুর।
স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিল্পীদের জন্য খুব যথাযথ ছিল স্থানটি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় নানা লোক সংগীত ও নৃত্যের আয়োজন পুরো শিল্পপ্রচেষ্টাকে দিয়েছিল নতুন মাত্রা। মুখোশ নৃত্য, ঝুমুর নৃত্য, বেঁদে গান, বাউল গান, লোটো গান, পটচিত্র প্রদর্শন ও গান এমনকি উচ্চাঙ্গ সংঙ্গীতের আয়োজনও করে আয়োজকরা। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আশা শিল্পীদের সামনে ভারতীয় লোক ঐতিহ্যের এমন উপস্থাপন নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবি রাখে। এমন বৈচিত্রময় সংস্কৃতির মধ্যে প্রায় দশদিন ধরে বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, ইতালি, রোমানিয়া, মঙ্গোলিয়া, নাইজেরিয়া, আলবেনিয়া, লেবানন, ইরান এবং স্বাগতিক দেশ ভারত এর পঞ্চাশজন শিল্পী পুরো আশেপাশের অঞ্চলকে ভরিয়ে তুলে নানা সমসাময়িক ধারার শিল্পকর্মকান্ড দিয়ে। শিল্পপ্রবণতাগুলোর মধ্যে ছিল ইনস্টলেশন আর্ট, সাইড স্পেসিফিক আর্ট ওয়ার্ক, লেন্ড আর্ট, পারফরমেন্স আর্ট এবং পেইন্টিং।
অংশগ্রহণকারি একজন শিল্পী হিসেবে এই রেসিডেন্সি প্রোগামের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছিলো পূর্ণচাঁদনি রাতে সাওতাঁলী ঝুমুর নাচ দেখা। ঝুমুর হলো সাওতাঁলদের ‘সোরহাই’ উৎসবের একটি নাঁচ যা জমি থেকে ফসল আনতে আয়োজিত হয়। মূলত এটি একটি কৃষি উৎসবনৃত্য। যেহেতু লোকশিল্পের কদর এখন শহরের মানুষদেরও তৈরি হচ্ছে ফলে বেশীরভাগ সময় নাগরিক হিসেবে লোকশিল্পের মৌলিক রূপ প্রকৃতির মাঝে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়না। যেহেতু আর্ট রেসিডেন্সি অদুরেই সাওতাঁল পল্লী ছিল তাই আয়োজকরা শিল্পীদের জন্য চাঁদনীরাতে ঝুমুর নাচেঁর আয়োজন করে, যে অভিজ্ঞতা ছিল কল্পনাতীত। এছাড়া প্রতিদিন যখন শিল্পীরা তাদের নিজেদের শিল্পকর্মের ছবি দেখাতো তখন স্থানীয় শতশত মানুষের উপস্থিতি এই আয়োজনকে যেন মানুষের মাঝে শিল্পকে ছড়িয়ে দেবার শিল্পীদায়িত্বকে বাস্তবায়িত করে। শুধু শিল্পকে নগরের গন্ডির মধ্যে না রেখে সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে দেবার যে প্রবণতা বিশ শতকের মাঝামাঝিতে শুরু হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথ যে ভাবনায় বিশ্বকে ভারতের দ্বারে নিয়ে এসে বিশ্বভারতী রচনার স্বপ্ন দেখেছিল তারই সফল প্রচেষ্ট যেন ‘নেরেটিভ মুভমেন্ট’ আর্ট অর্গানাইজেশানের এই ‘গোল্ডেন থ্রেড’ আর্ট রেসিডেন্সি।