তিনবারের অস্কারজয়ী অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে-লুইস চলচ্চিত্র থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন সদ্য। নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে ম্যাগাজিন ভ্যারাইটি-কে গত মাসের মাঝামাঝি তিনি এই সিদ্ধান্ত জানান। নির্মাতা পল থমাস এন্ডারসনের সিনেমা ফ্যান্টম থ্রেড-ই তাহলে হবে ৬০ বছর বয়সী এই অভিনেতার শেষ কাজ। ফ্যান্টম থ্রেড এই বছরের বড়দিনে মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
ফ্যান্টম থ্রেড এর পটভূমি ১৯৫০-এর লন্ডন, ফ্যাশন ডিজাইনার রেনল্ডস উডককের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডে-লুইস। উডকক লন্ডনের ফ্যাশন জগতের খুব পরিচিত নাম, তার বানানো ড্রেসের খ্যাতি শহরজোড়া। উডককের জীবনে প্রেম আসে বেশ দেরিতে- সেই প্রেম আবার অনেক জটিলতার ভিতর আবর্তিত হয়। ইউটিউব ট্রেইলার খুব দৃষ্টিনন্দন সন্দেহ নেই, কিন্তু সিনেমা নিয়ে খুব বেশি কিছু জানায়না। ডিরেক্টরের ভাষ্যমতে- এটা প্রেম কাহিনীই, কিন্তু গল্পটা খুব আকাঙ্ক্ষিত কোন পরিণতিতে নিয়ে যাবেনা আপনাকে। পল থমাস এন্ডারসনের পরিচালনায় এটি ড্যানিয়েল ডে-লুইসের দ্বিতীয় সিনেমা- প্রথমটা ২০০৭ এর ছবি দেয়ার উইল বি ব্লাড, এই ছবির ড্যানিয়েল প্লেইনভিউ চরিত্রের জন্য ডে-লুইস সেরা অভিনেতার অস্কার পেয়েছিলেন দ্বিতীয়বারের মতো।
ড্যানিয়েল ডে-লুইস এর জন্ম ১৯৫৭ সালে, লন্ডনে; বাবা কবি, অভিনেত্রী মা। ছোটবেলা থেকেই তিনি হাতের কাজে পটু- কাঠ খোদাই আর আসবাবপত্র বানানোর কাজ করতেন। অভিনয়ের শুরু থিয়েটারে- তিন বছর থিয়েটার একাডেমিতে অভিনয় শিখেছেন বটে, কিন্তু তাকে স্বকীয় করেছে তার স্বভাব অভিনয়ের ক্ষমতা। যেকোন চরিত্রের জন্যই প্রচুর খাটুনি, চরিত্রকে নিজের জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলা আর চরিত্রকে আত্মীকরণ করতে অদ্ভুত অদ্ভুত উপায় অবলম্বন- নিজের প্রায় তিনদশকের অভিনয় জীবনে এমন উদাহরণের অভাব নেই তার।
১৯৮৯ সালে তিনি মঞ্চ থেকে অবসর নিয়েছেন, তার শেষ কাজটি ছিল লণ্ডনের রয়াল থিয়েটার হলে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক হ্যামলেটের মঞ্চায়ন। হ্যামলেটের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তিনি। পিতার বিদেহী আত্মার সাথে যুবরাজ হ্যামলেটের কথাপকথনের দৃশ্যে ডে-লুইস কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে বের হয়ে যান এবং আর তিনি কখনো মঞ্চে অভিনয় করেননি। পরবর্তীতে তাকে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানিয়েছেন তার নিজের পিতার আত্মা তাকে সেই সময় অনেক বেশি দখল করে ফেলেছিলো এবং তিনি কোনভাবেই আর অভিনয় চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। তার প্রথম অস্কারজয়ী চরিত্র- মাই লেফট ফুট-এর ক্রিস্টি ব্রাউন- বাস্তবে যিনি ছিলেন একজন প্রতিবন্ধি চিত্রকর, নিজের বাম পা বাদে শরীরের কোন অংশই ব্যবহার করতে পারতেন না। এই চরিত্রে প্রবেশ করার জন্য তিনি পুরোটা শ্যুটিং এর সময় হুইলচেয়ারেই চলাফেরা করেছেন।
১৯৯২ সালে দ্য লাস্ট অব দ্য মোহিকান্স এ অভিনয়ের আগে তিনি প্রায় ছয়মাস লোকালয়ের বাইরে ছিলেন- নির্জনতায় বনেজঙ্গলে সময় কাটিয়েছেন- মাছ ধরেছেন, শিকার করেছেন। ১৯৯৮ সালের পর মাত্র ছয়টি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন, প্রত্যেকটি চরিত্রের পেছনে আছে তার অক্লান্ত পরিশ্রম। মারটিন স্করসিসির ২০০২ সালের ঐতিহাসিক ক্রাইম এপিক গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্কের বুচার বিল চরিত্রের জন্য দীর্ঘ সময় তিনি মাংস কাটার ছুরি হাত থেকে নামাতেন না।
অভিনীত চরিত্রকে জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলার জন্যই অভিনয় কখনো কখনো খুব বেশি ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। দুইটি চলচ্চিত্রের মধ্যে বড় বড় ছুটি নেয়ার কারণ-ও তার এটিই। ২০০৮ সালে গার্ডিয়ান-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন অভিনয় কীভাবে তার কাছ থেকে জীবনিশক্তি নিংড়ে নেয়- ‘একটা ভয়াবহ বিষণ্ণতা কাজ করে। শ্যুটিং এর শেষ দিনটাকে অবাস্তব মনে হয়। আপনার শরীর, মন, আত্মা মানবেই না যে এই অভিজ্ঞতাটাও শেষ হতে চলেছে।‘
দীর্ঘ অভিনয়জীবনে ডে-লুইস অনেকবার ছোট ছোট অবসর নিয়েছেন তার কাজ থেকে; তবে এইবারের অবসরের সিদ্ধান্তটি সম্ভবত আর পালটাবে না। ক্যারিয়ারে তার সাফল্য সবসময়ের অভিনেতাদের কাছেই ঈর্ষণীয়; তার ঝুলিতে পুরষ্কারের অভাব নেই। ২০১২ সালে টাইমস তাকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ বলে ঘোষণা করে। ২০১৪ সালে অভিনয়ে অবদানের জন্য নাইটহুড পান তিনি। অভিনয় ছাড়া কীভাবে জীবন কাটাবেন, এই নিয়ে অবশ্য খুব বেশি ভাবছেন না এখনি। হয়তো ছবি আঁকবেন, কিংবা কাঠের কাজের দিকে ঝুঁকবেন আবার।
অস্কার মৌসুমের আগে আগে মুক্তি পাচ্ছে ফ্যান্টম থ্রেড। স্বীকৃত নির্মাতা, অসাধারণ অভিনেতার সমন্বয়ে এইবার অস্কার কাঁপানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে সিনেমাটির। কে বলতে পারে- চতুর্থবারের মতো সেরা অভিনেতার অস্কার নিয়েই হয়তো রূপালি পর্দা ছাড়বেন স্যার ড্যানিয়েল ডে-লুইস!