প্রখ্যাত রকস্টার জিম মরিসনের জন্মদিন আজকে। তিনি ও তার ব্যান্ড দ্য ডোরস ষাটের দশকের রক মিউজিকের পুরোধাদের অন্যতম। উদ্ভট বেপরোয়া জীবনযাপন এবং সব ধরনের পুরনো প্রথার প্রতি বিতৃষ্ণা- এসব নিয়েই নিজের জীবনকে এক উজ্জ্বল কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিলেন এই কবি,গীতিকার ও গায়ক। ভক্তদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দ্য লিজারড কিং’ নামে। সমগ্র ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যকার যে প্রতিবাদ, হিপ্পি আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধীতা আর প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অবস্থান- এসব কিছুতেই মরিসন, তার কবিতা ও গান, তার দুর্দান্ত কাউকে-না-মানা রকস্টার প্রতিবিম্ব নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। তরুণদের কাছে মরিসন ছিলেন শিল্পে জাজ্জ্বল্যমান এক প্রতিনায়কের ছবি।
পরিবারের দেয়া নাম জেমস ডগলাস মরিসন। জন্ম ফ্লোরিডায় ১৯৪৩ সালে। বাবা ছিলেন ইউএস নেভিতে। ছোটবেলা থেকে কড়া শৃঙ্খলায়-শাসনে মানুষ হয়েছেন। বাঁধাধরা অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দানা বাঁধা শুরু হয় এখান থেকেই। কবিতা তাকে আক্রান্ত করে স্কুলে পড়ার সময়; ফরাসি কবি জাঁ আর্তুর র্যাঁবো আর নীৎশের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন তিনি। র্যাঁবোর প্রভাব পরবর্তীতে তার লিরিকেও প্রায়ই এসেছে- পরাবাস্তব বিভিন্ন প্রতীকের আড়ালে। কলেজে ঢুকেই অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস শুরু হয়, মাতাল হয়ে একবার ঢুকে পড়েন ফুটবল মাঠে। প্রথমবারের মতো জেলে যেতে হয় মরিসনকে, যার ধারাবাহিকতা তার ছোট জীবনে এর পরেও চালু ছিলো।
১৯৬৪-তে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হন, থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। মরিসনের ভেতরকার শিল্পতৃষ্ণা আবার উপযুক্ত পরিবেশ পায়। যে পরাবাস্তবতা তাকে আশৈশব মজিয়ে রেখেছিলো, তা আরো বেশি পোক্ত হয় এই সময়ে। দ্য ডোরস এর গানে যে সাইকেডেলিক আবহাওয়া- সেটা গঠনে মরিসনের এই স্যুররিয়ালিটির প্রতি ঝোঁক বেশ জরুরি প্রভাবক ছিলো। জিম মরিসন তার গ্র্যাজুয়েশানের জন্য বেশ কিছু শর্টফিল্ম বানান। ডোরস এর শুরুও এসময়েই। পরবর্তীতে ব্যান্ডের বেজিস্ট রে মানজারেকের সাথেও তার পরিচয় এই ফিল্ম স্কুলেই। মানজারেক ছিলেন তার সিনেম্যাটোগ্রাফির ক্লাসমেট। শুরু এই দুজনকে দিয়েই, মানজারেক মরিসনের লিরিক দেখে বেশ মুগ্ধ ছিলেন। ব্যান্ডে ভোকাল দেয়াই ছিলো মরিসনের কাজ, মাঝে মাঝে ট্যাম্বুরিন আর হারমোনিকা বাজাতেন।
গ্র্যাজুয়েশানের পরে যে বোহেমিয়ান জীবনযাপন শুরু করেছিলেন জিম মরিসন, ব্যান্ড শুরু হওয়ার পরে তা আরো গতি পায়। মার্কিন রক মিউজিকে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো দ্য ডোরস। কাব্যিক কথার সাথে বিচিত্র সুর, তার উপর মরিসনের শক্তিশালী আর ভীষণ বাঁধনছাড়া ব্যক্তিত্ব তো ছিলোই। আমেরিকান চিরাচরিত ব্লুজের সাথে সাইকেডেলিক উপাদানের সঙ্গতে দ্য ডোরস নতুন এক ধরনের শব্দ তৈরি করছিলো। এই নতুন গানে সাড়া দিচ্ছিলো ষাটের প্রথা-না-মানা শ্রোতাদের একটা বড় অংশ। এসময় জিম মরিসন সারাক্ষণই মাতাল থাকতেন প্রায়, মঞ্চে উঠলে তাকে মনে হতো প্রচণ্ড ঘোরগ্রস্থ। অনেক গানেই হঠাৎই লিরিকের সাথে নতুন অংশ যোগ করে গেয়ে উঠতেন। ১৯৬৭ সালেই দ্য ডোরস এর প্রথম দুটি এলবাম বের হয়- বছরের শেষ দিকে এক লাইভে তার আচরণ এতই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে যে স্টেজ থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার পর শ্রোতাদের মধ্যে তাকে নিয়ে পাগলামি আরো বেড়ে যায়- তার বেপরোয়া স্বভাব কিংবদন্তী হয়ে উঠতে থাকে।
জিম মরিসনের প্রথম কবিতার বই বের হয় ১৯৬৯ সালে। কবিতায়ও তিনি ছিলেন উচ্চকিত, বিদ্রোহী- তার শিল্পরুচি অনেকখানি প্রতিফলিত তার কবিতায়। দ্বিতীয় কবিতার বই টানা গদ্যে- পঞ্চাশের দশকের বিট আন্দোলনের ছাপ আছে কবিতাগুলোতে। নিজের সাথে কথা বলার ধরনেও বেশ কিছু লেখা আছে তার। এসবে আরো অনেক অন্তর্গত, নির্জন মরিসনের ছাপ পাওয়া যায়। দ্য ডোরস এর অধিকাংশ লিরিকই মরিসনের লেখা। তার লেখালেখির একটা প্রভাব তাদের গানে সবসময়ই বেশ স্পষ্ট ছিলো। জিম মরিসনের কণ্ঠে নিজস্বতা ছিলো শুরু থেকেই। ১৯৭০ এর দিকে তার কণ্ঠ আরো ভারী হয়ে উঠতে থাকে, রুক্ষতা আসে। তার সাতাশ বছরের জন্মদিনে দ্য ডোরস রেকর্ড করে ‘অ্যান আমেরিকান প্রেয়ার’। এই এলবামে জিম মরিসন তার কবিতাগুলো আবৃত্তি করেছেন। কোন সুর নেই, তার দরাজ কণ্ঠে কবিতা পড়ার পিছনে বাজিয়েছে ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যরা। এখানে একেবারে অন্য মরিসনকে খুঁজে পাওয়া যায়, বেশ শান্ত কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ। এই এলবাম বের হয় মরিসনের মৃত্যুর অনেক পরে ১৯৭৮ সালে। এটাই দ্য ডোরস এর শেষ এলবাম।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ে জিম মরিসন মারা যান। মৃত্যুর কারণ এখনো জানা যায়নি স্পষ্টভাবে। সেইসময় মরিসন প্যারিসে এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকছিলেন- তার প্রেমিকা তাকে বাথটাবে মৃত অবস্থায় পায়। ডাক্তারি রিপোর্টে কারণ বলা ছিলো হার্ট ফেইলিউর, অনেকে মনে করেন তার ড্রাগডিলারের হাত আছে এই মৃত্যুর পিছনে। ২৭ বছর বয়সে মারা যান মরিসন। এবং জিমি হেন্ড্রিক্স, জেনিস জপলিন, কার্ট কোবেইনদের মতো রকস্টারদের জন্য টুয়েন্টি সেভেন ক্লাব শুরু করে ফেলেন। রক মিউজিক ইতিহাসের এই আশ্চর্য ট্র্যাজেডি আরো মহৎ, আরো বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে ভক্তদের চোখে।
ষাটের কাউন্টার কালচার আর রক এন রোল মিউজিকের ঘোরলাগা সময়ে জিম মরিসন তারুণ্য আর বিদ্রোহের আইডল হয়ে উঠেছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও তা জারি আছে। রোলিং স্টোনস ম্যাগাজিনের সর্বকালের সেরা একশ গায়কের তালিকায় তার নাম ৪৭-এ। অজস্র সিনেমা, সাহিত্য, গানের উপর তার কণ্ঠ আর ব্যক্তিত্বের প্রভাব। ১৯৯১ সালে ভ্যান কিলমার অভিনীত ‘দ্য ডোরস’ কিংবা ২০১১ এর বলিউড সিনেমা ‘রকস্টার’– তার জীবন থেকে সরাসরি প্রভাবিত। জিম মরিসন- দ্য লিজারড কিং, তার এই চুয়াত্তরতম জন্মদিনেও এখনো নিয়ম-না-মানা রকস্টারের প্রতীক।