শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও বাংলাদেশ

১.

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হচ্ছে শাস্ত্রের নিয়মাদি মেনে চলা সঙ্গীত। সঙ্গীতকে যে সব নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর দিয়ে চলতে হয় সেই নিয়মগুলো শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস অনেক পুরানো। বৈদিক যুগ থেকে এই সঙ্গীতের চর্চা চললেও প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকে মন্দিরে সুরের মাধ্যমে স্তোত্র পাঠ করা হত। বৈষ্ণবরা এই স্তোত্র পাঠ করতেন। ধারণা করা হয়, সেই স্তোত্রের সুর থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ। এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রাগ সঙ্গীত, ধ্রুপদি সঙ্গীত বা শুদ্ধ সঙ্গীত নামে পরিচিত।

একাদশ শতাব্দীতে চালুক্যরা এই অঞ্চলে অভিযানে আসে। চালুক্য সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন সাম্রাজ্য। এই সম্রাজ্য ষষ্ঠ  থেকে বার শতক পর্যন্ত শাসন করেছে। দ্বিতীয় পুলকেশ ছিলেন চালুক্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সময়ে প্রশাসনিক দক্ষতা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারে এই সাম্রাজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল। সেই সময় চালুক্য সাম্রাজ্যের সাথে বহু কর্ণাটকী পরিবারও এ অঞ্চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। সেন রাজারা কর্ণাটকী পরিবারেরই বংশধর। সেন বংশের হাতে রাজত্ব যাওয়ার পর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বেশ প্রসার ঘটে। কারণ তাঁরা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। এই অঞ্চলের শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন ‘জয়দেব’। তাঁর  রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ একটি প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ। গীত গোবিন্দের পদগুলো ছিল প্রবন্ধ শ্রেণির সঙ্গীত।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এই ভারত উপমহাদেশে দুটি ভাগে বিভক্ত। হিন্দুস্তানি সঙ্গীত আর কর্ণাটকী সঙ্গীত। হিন্দুস্তানি সঙ্গীত উত্তর ভারতে প্রচলিত। কর্ণাটকী সঙ্গীত মহীশূর, অন্ধ্র, মাদ্রাজ ও কর্ণাটক অঞ্চলে প্রচলিত। দুটি পদ্ধতিই আপন ও স্বকীয়তা নিয়ে অনুশীলিত হচ্ছে।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুইভাবে পরিবেশিত হয়। কণ্ঠসঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে। সরোদ, সেতার, সুরবাহার, বীণা, সারেঙ্গী, বাঁশি, বেহালা, সন্তুর, তবলা, পাখোয়াজ, মৃদঙ্গ, তানপুরা, এস্রাজ ইত্যাদি যন্ত্রের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিভিন্ন রাগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র

রাগ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো রঙ। সুরের যে রঙ মনকে আন্দোলিত করে তাকেই রাগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাতটি স্বরের চলনে মাধুর্যতা তৈরি করাই হচ্ছে রাগ। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সময় ও কাল নির্ভর প্রায় ছয় হাজার রাগ রয়েছে। এদেশে ছয়টি ঋতু আছে। এ ছয়টি ঋতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দীপক, মেঘ, ভৈরব, মালকৌশ, শ্রী ও হিন্দোল অন্যতম। রাগের গঠন ও প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্ত্রে রাগ পরিবেশনের সময় ও কাল উল্লেখ রয়েছে। যেমন সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত। আবার প্রহর অনুযায়ীও ভাগ রয়েছে, প্রহর অনুযায়ী রাগ পরিবেশন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

২.

সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। তবে সঙ্গীতগুরু সবাই হতে পারেন না। এর জন্য বিশেষ সঙ্গীতগুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। একজন শিক্ষার্থী তার মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে সঙ্গীতগুরুকে জেনে-বুঝে নির্বাচন করেন। প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শুরু হলেও বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অত্যন্ত ধীত গতিতে এগিয়েছে। গুটিকয়েক সংগঠন আর অল্প কয়েকজন সঙ্গীতগুরু ছাড়া এদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তেমন প্রসার লাভ করেনি। বাংলাদেশে যে সব সঙ্গীত গুরু আছেন তাঁদের মধ্যে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার, ওস্তাদ মুনশি রইস উদ্দিন, ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, ওস্তাদ আলি আকবর খান, ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ও ওস্তাদ সঞ্জীব দেসহ কয়েকজন গুণী ওস্তাদ বা পণ্ডিতের নাম শোনা যায়।

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার

বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার অবদান অনস্বীকার্য। দেশের ভাগের পর তিনি পাবনায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসারের লক্ষ্যে একটানা কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর কাকরাইলের একটি বাসায় ১৬ জন শিক্ষক এবং ১১ জন ছাত্রছাত্রীর সহায়তায় দেশের প্রথম সঙ্গীত শিক্ষালয় ‘কলেজ অব মিউজিক’ এর কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে সংগীত মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পরিণত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে সংগীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঢাকার রমানায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-এ সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে নাজকোত-সালামত, আমানত-ফতেহ, মেহেদী হাসান, আসাদ আলী খানসহ বহু গুণী শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশনের অধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সঙ্গীত ‍বিষয়ক সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং ওই কমিটির চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘সংগীত কলি’ ও ‘সুর লহরী’ নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে বারীণ মজুমদার বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।

বিশ্বের প্রথিতযশা শিল্পীদের পরিবেশনায় প্রাণোচ্ছল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব

যে গুটিকয়েক সংগঠন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করে তাদের মধ্যে ঢাকার ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, চট্টগ্রামের সদারঙ্গ, নারায়ণগঞ্জের লক্ষাপার, রাজশাহীর হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যশোরের ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন স্মরণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন এবং ঢাকায় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব শুদ্ধ সঙ্গীত প্রচার এবং প্রসারে অনন্য ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব বড় পরিসরে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ সুনামের সাথে এই উৎসব আয়োজন করেছে। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন বিশ্বের প্রথিতযশা শিল্পী ও পণ্ডিতরা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে তুলনামূলক স্বল্প পরিসরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা করা হলেও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’। এই প্রতিষ্ঠানে ধ্রুপদে তালিম দেন পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, সরোদে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, সেতারে পণ্ডিত কুশল দাস, খেয়ালে পণ্ডিত উলহাস কশলকর, তবলাতে পণ্ডিত সুরেশ তলওয়ালকরসহ অন্যান্য সংগীতগুরুরা। সংগীত প্রতিভা অন্বেষণ, মৌলিক জ্ঞান ও শাস্ত্রীয় সংগীতে দক্ষ শিক্ষার্থী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই উদ্যোগ নিয়েছে।

৩.

বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা বেশ প্রাচীন। সংস্কৃতির অগ্রগতির পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছে। এই বিকাশ লাভ আরও সুদূর প্রসারী হতে পারতো যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চায় আরও অধিক সংখ্যক সংগঠন ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকতো।