প্রথম বইটি প্রকাশের ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো যে জে. কে. রাওলিং-এর জাদুর পৃথিবীর মোহ এতটুকুও কমেনি তা দেখা যায় পটারহেডদের বিভিন্ন বিষয়ে, অনুষ্ঠানে তুমুল উত্তেজনা দেখে। এখনো বিশ্বজুড়ে হাজারো পটারহেড অপেক্ষা করে আছেন কবে অধ্যাপক মিনার্ভা ম্যাকগোনাগলের কাছ থেকে আসবে সেই চির আকাঙ্ক্ষিত চিঠি, কবে তারা প্রবেশ করবে প্ল্যাটফর্ম নাইন অ্যান্ড থ্রি কোয়ার্টারে, “হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস” চড়তে। পোশন কিংবা ডিফেন্স এগেইন্সট ডার্ক আর্টসের ক্লাসরুমে মজাদার পড়াশুনা, হগওয়ার্টসের গোপন সুড়ঙ্গগুলো, কুইডিচ টুর্নামেন্ট অথবা কালো জাদুকরদের শায়েস্তা করার স্বপ্নে মশগুল এই পটারহেডদের জন্যে কিন্তু হগওয়ার্টসই একমাত্র স্কুল নয়। হগওয়ার্টসের নিয়মানুযায়ী এর ছাত্র হতে হলে আগ্রহীকে অবশ্যই হতে হবে গ্রেট ব্রিটেন কিংবা আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা। তাই বলে কি বঞ্চিত থাকবে বিশ্বজুড়ে লাখো জাদুকর? সবার জন্যেই জাদুশিক্ষা নিশ্চিত করতে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু জাদুর স্কুল।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই কোন জাদুর স্কুল না থাকলেও “ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন্স অফ উইজার্ডস” এর খাতায় লিপিবদ্ধ এরকম স্কুলগুলো সারা বিশ্বজুড়েই প্রস্তুত করছে খুদে জাদুকরদের। এ রকম স্কুলের সংখ্যা এগারটি হলেও আটটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় এই মাগলদের পৃথিবী থেকে। হ্যারি, রন, হারমাইয়োনির সুবাদে হগওয়ার্টসটা নিজের হাতের তালুর মতই পরিচিত থাকলেও বাকি স্কুলগুলো যেন রয়েছে গিয়েছে অনেকটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই। এবার দেখে নেয়া যাক এই সাতটি স্কুলের গল্প।
ইলভারমরনি স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ডিঃ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটসের গ্রেলক পর্বতাঞ্চলে অবস্থিত ইলভারমনি উত্তর আমেরিকার একমাত্র জাদুর স্কুল। এ স্কুলে সমগ্র মহাদেশ থেকেই আসতে পারেন ছাত্ররা। গ্রানাইটের পাথরে নির্মিত এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৩৭ সালে, ব্রিটেন থেকে পালিয়ে আসা এক জাদুকরী ইসোল্ট সায়ারের হাত ধরে। শুরুতে নিজের পালিত দুই সন্তানকে জাদুশিক্ষায় দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করলেও ধীরে ধীরে আদিবাসী আমেরিকানদের মধ্যেও সমানভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে স্কুলটি। হগওয়ার্টসের মত এ স্কুলেও রয়েছে চারটি হাউজ। জাদুর দুনিয়ার প্রাণীদের নামে নামকরণ করা হাউজগুলোতেও ছাত্র-ছাত্রী বাছাইয়ের সময়ে দেখা হয় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া “ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হয়্যার টু ফাইন্ড দেম” এ ম্যাজিকাল কংগ্রেস অফ ইউনাইটেড স্টেটসে কাজ করা জাদুকরেরা প্রায় প্রত্যেকেই ইলভারমরনির প্রাক্তন ছাত্র। ইলভারমনির ছাত্রদের পোশাকে থাকে গাঢ় নীল এবং ক্র্যানবেরি রঙ।
বোব্যাহটনস অ্যাকাডেমি অফ ম্যাজিকঃ গবলেট অফ ফায়ারের ফ্লেউর ডেলাকোউরের কথা তো সবারই মনে আছে, কিংবা হ্যাগ্রিডের প্রিয় ম্যাডাম ম্যাক্সিমকে? এ স্কুলটি ফ্রান্সের পিরেনিজ পর্বতাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির মধ্যে অবস্থিত। স্কুলটির চারিদিক অনিন্দ্য সুন্দর বাগান দিয়ে সজ্জিত। পরিবেশের মতই বোব্যাহটনসের ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিফর্মেও রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। সিল্ক দিয়ে বানানো আকাশী নীলের এই ইউনিফর্ম যে কারোই চোখ কেড়ে নিতে বাধ্য। ছাত্র-ছাত্রী এবং স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা যাতায়াতের জন্যে ব্যবহার করে উড়ন্ত ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ১২৯৪ সালের ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্টের প্রথম আসর থেকেই এতে অংশ নেয় বোব্যাহটনস। হগওয়ার্টসের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাও বেশ জমজমাট এ ক্ষেত্রে। পরশ পাথরের আবিষ্কর্তা বিখ্যাত আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল এবং তার স্ত্রী পেরেনেলে এ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। ফ্রান্সের পাশাপাশি বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও স্পেনের খুদে জাদুকরেরাও পড়তে পারেন এ স্কুলে।
ডার্মস্ট্র্যাং ইনস্টিটিউটঃ নরওয়ে এবং সুইডেনের সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত ডার্মস্ট্র্যাং স্কুলটি তাদের পাঠ্যক্রমে কালো জাদু শেখানোর জন্যে কুখ্যাত। পাহাড় এবং হ্রদে ঘেরা এই স্কুলটি আয়তনেও বাকিগুলোর মতো বড় নয়। ইউরোপের জাদুর স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মধ্যযুগের বিখ্যাত বুলগেরিয়ান জাদুকরী নেরিদা ভুলচানোভা। ছাত্রছাত্রী বাছাইয়ে ভৌগোলিক সীমারেখার কোনো হিসাব নিকাশ মানেনা এই বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শর্ত একটাই, তাকে হতে হবে বিশুদ্ধ রক্তের। মাগল পরিবারের কোন সদস্যকে নিতে একেবারেই রাজি নয় স্কুলটি। ডার্ক আর্টসের দিকে মনোনিবেশকারী এ বিদ্যালয়ের ছাত্রই ছিলেন ভোল্ডেমর্ট পূর্ববর্তী সময়ের সবচেয়ে কুখ্যাত কালো জাদুকর গ্যালার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ড। যদিও তার কালো জাদুর প্রতি প্রবল মোহ ডার্মস্ট্র্যাং-এর জন্যেও হয়ে পড়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সে জন্যেই স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। এছাড়াও স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক ইগর কারকারফও ছিলেন লর্ড ভোল্ডেমর্টের অনুসারী। পশমে আবৃত গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরিধান করেন এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। হগওয়ার্টস এবং বোব্যাহটনসের মতই ডার্মস্ট্র্যাংও শুরু থেকেই অংশ নেয় ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্টে। বুলগেরিয়ার বিখ্যাত সীকার এবং ইউল বলে হারমাইয়োনির নাচের সঙ্গী ভিক্টর ক্রামও এ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন।
কলডভস্টোরেটজঃ রাশিয়ার এ জাদুর স্কুলটি অবস্থান কিংবা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক জাদুকরদের জগতে কৌতূহল থাকলেও আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে এ বিদ্যালয়টি। শুধুমাত্র রুশ ছাত্রছাত্রীরাই পড়াশুনা করতে পারে এ বিদ্যালয়টি। তবে বিশেষ বিবেচনায় এশিয়ার কিছু দেশ থেকেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ বিদ্যালয়টি কুইডিচ খেলার নতুন একটি সংস্করণ অনুসরণ করায় বেশ আলোচিত। এ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কুইডিচ খেলার সময়ে ঝাড়ুর পরিবর্তে ব্যবহার করে আস্ত গাছ।
মাহুতোকোরো স্কুল অফ ম্যাজিকঃ এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত এ জাদুর স্কুলটি জাপানের আগ্নেয়গিরির দ্বীপ মিনামি ইও জিমায় অবস্থিত। জাদুর স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ছাত্র সম্বলিত এ স্কুলটি খুব সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুর স্কুল। সাত বছর থেকেই ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করালেও তাদেরকে এগার বছর বয়সে এসে আবাসিক সুবিধা দেয়া হয়। এ চার বছর প্রতিদিন এ ছাত্রছাত্রীরা দানবাকৃতির সামুদ্রিক ঈগলের পিঠে ভ্রমণ করে ক্লাসে অংশ নিতে আসে। স্কুলের ইউনিফর্মটাও বেশ মজার। বাকি স্কুলগুলোর মত কোন নির্দিষ্ট রঙ না থেকে, এই স্কুলের ইউনিফর্মের রঙ পরিবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত। গোলাপী থেকে শুরু করে স্কুলে ভাল ফল কিংবা অর্জনের উপর ভিত্তি করে রঙ ধীরে ধীরে সোনালীতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু কোন ভাবে স্কুলের নিয়ম ভাঙলেই হয় বিপদ! ইউনিফর্মের রঙ হয়ে যাবে সাদা, সাথে সাথেই বের করে দেওয়া হবে বিদ্যালয় থেকে। কুইডিচে খুবই বিখ্যাত এ স্কুলের এ খেলার সাথে প্রথম পরিচয়টাও হয়েছিল পথ ভুল করে এ স্কুলে এসে পরা হগওয়ার্টসের কয়েক ছাত্রের কল্যানে, কয়েক শতক আগে। প্রচণ্ড প্রতিকূল আবহাওয়ায় কুইডিচ খেলা এ স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছে পৃথিবীখ্যাত অসংখ্য কিংবদন্তী কুইডিচ খেলোয়াড়।
ক্যাসেলোব্রুক্সোঃ আমাজনের গহীনে অবস্থিত এই ব্রাজিলিয়ান জাদুর স্কুলটি সমগ্র দক্ষিন আমেরিকা থেকেই খুদে জাদুকরদের বাছাই করে ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে। হগওয়ার্টসের সমসাময়িক এ স্কুলটিকে মাগলরা দেখলে মনে করবে কোন ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ। স্কুলটি থাকে কাইপোরা নাম্নী ছোট এবং দুষ্টুমিতে ওস্তাদ এক ধরণের ভূত। ইউরোপের বিখ্যাত স্কুলগুলোর সাথে শিক্ষার্থী বিনিময়ের মাধ্যমে ক্যাসেলোব্রুক্সো আন্তর্জাতিক জাদু সম্প্রদায়ের সাথে একটি সুসম্পর্ক রক্ষা করে সব সময়। অবস্থানগত কারণে আমাজনের গহীনের অসংখ্য জাদুর গাছপালা এবং প্রাণীদের খুবই কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পায় এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ফলে হার্বোলজি এবং ম্যাজিকজুয়োলজি- এ দুই বিষয়ে এ স্কুলকে টক্কর দেয়া অসম্ভবই বলতে গেলে। এ স্কুলের ইউনিফর্মের রঙ গাঢ় সবুজ।
উয়াগাদু স্কুল অফ ম্যাজিকঃ উগান্ডার বিখ্যাত এবং রহস্যময় “মাউন্টেইন অফ মুন” অথবা চাঁদের পাহাড়ে অবস্থিত “উয়াগাদু স্কুল অফ ম্যাজিক” আফ্রিকা মহাদেশের একমাত্র জাদুর স্কুল। এ স্কুলটি আয়তন কিংবা ছাত্রছাত্রী সংখ্যাও অন্য সকল স্কুলকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সমগ্র আফ্রিকা থেকে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করা এ স্কুলটিও হগওয়ার্টসেরই সমসাময়িক। উয়াগাদুর ছাত্রছাত্রীরা জাদু প্রয়োগে ওয়ান্ড ব্যবহারের চেয়ে নিজেদের আঙুলের ইশারাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ট্রান্সফিগারেশনে এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুবই পারদর্শী, মুহূর্তেই খুবই সহজেই তারা পরিণত হতে পারে হাতি কিংবা চিতাবাঘের মত প্রাণীতে। স্কুলটি রহস্যময় কুয়াশায় এমনভাবে আবৃত থাকে, দূর থেকে মনে হয় মেঘে ভেসে বেড়ানো কোন পারলৌকিক প্রাসাদ।