অ্যাশেজ-জাতীয়তাবাদের ক্রিকেটীয় সংস্করণ

ঢাকার মাঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সদস্য হিসেবে মাথায় বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে মাঠে নেমেছিলেন ক্রিকেটার রকিবুল হাসান। জাতীয় চেতনা বোধের সে অভিনব প্রদর্শনকে আজও আমরা বেশ গর্বের সাথে স্মরণ করি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় তো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল হয়ে উঠেছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রামের বৈশ্বিক দূত।

খেলার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ নতুন কিছু না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ অলিম্পিক নিজেই। গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরিয়া হয়ে লড়াই করত। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে পুরো ঔপনৈবেশিক কালে খেলার জাতীয়তাবাদী সংস্করণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সামাজ্রের হাত ধরে সারা বিশ্বে জোড়া কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের খেলা ক্রিকেট।

ক্রিকেট মাঠের চৌহদ্দি হয়ে উঠেছিল শাসক ও শাসিতের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্বের দ্বৈরথ।  ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। অসাধারণ নৈপুণ্যে ৭ রানে সেই ম্যাচ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। সব সময় খবরকে এককাঠি সরেস বানানোতে ওস্তাদ ব্রিটিশ গণমাধ্যম ইংল্যান্ডের সেই পরাজয়কে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ‘দ্য স্পোর্টিং টাইম’ লিখেছিল- ‘ওভালে ইংলিশ ক্রিকেটের মৃত্যু হয়েছে’। পাদটীকায় লিখা ছিল-শবদাহ করা হয়েছে, এবং ছাই নেওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সেই থেকে শুরু অ্যাশেজ। আর সেই থেকে শুরু ক্রিকেটের জাতীয়তাবাদী সংস্করণের সবচেয়ে বড় আসর অ্যাশেজ সিরিজ।

১৯৬৪ সালের অ্যাশেজ সিরিজে গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের একাংশ

অ্যাশেজের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা। অস্ট্রেলিয়াবাসীরা সব সময় মনে করে ব্রিটিশরা তাদের নিচু চোখে অর্থাৎ শাসিত জাতি হিসেবে দেখছে। দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকার ফলে অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের অবচেতনের গভীরে এ মানসিকতা শিকড় গেড়েছে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ক্রিকেট বোর্ড ছিল। উপনিবেশিক শাসনের ব্যথা ভুলে জাতীয়তাকে সামনে তুলে ধরতে তখন থেকে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম নিজ দেশের ক্রিকেটকে আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে অনন্য উচ্চতায় দেখানোর প্রচেষ্টায় ছিল অবিশ্রান্ত।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না- এমনটিই ভাবত শাসকসহ ব্রিটিশ আপামর জনগোষ্ঠি। সেই জাতিকে পৃথিবীর এক কোণায় থাকা কোনো এক জাতি হারিয়ে দেবে তা মানতেই নারাজ ছিল ব্রিটিশরা। এটি শাসকদের শাসিতকে পদানত করার চিরাচরিত জাতীয়তাবাদী মানসিকতা। দুই দলের এ লড়াইয়ে দলের পেছনে থাকত নিজ নিজ জাতি। মাঠের বাইরে সেকারণেই বাক যুদ্ধে নামতো দুই দেশের গণমাধ্যমে থেকে শুরু করে গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও।

দলের হার মানে পুরো জাতির শ্রেষ্ঠত্বের হার। উভয় পক্ষই জাতি হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণে ২২ গজের পিচে লড়াই করে। এ লড়াই শুধু খেলায় জয়-পরাজয়ে আটকে থাকে না। খেলার মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে দুই দল। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৩২-৩৩ সালের বডি লাইন বোলিং আক্রমণ।

১৯৪৮ সালের অ্যাশেজ সিরিজে স্যার ডন ব্রাডম্যান

শুধু অ্যাশেজ দ্বৈরথে সীমাবদ্ধ নেই ক্রিকেটের জাতীয়তাবাদী সংস্করণ। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোতে নিয়ে এসেছিল ক্রিকেট; যার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ কলকাতার ইডেন গার্ডেনের মাঠ। খেলার মাঠে উপনিবেশিক শাসকদের হারিয়ে শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব জানানোর সবচেয়ে নির্ভেজাল জায়গা হয়ে দাঁড়ায় ক্রিকেট।  ২০১১ সালে ভারতের বিখ্যাত খেলোয়াড় রাহুল দ্রাবিড় ব্রাডম্যানকে নিয়ে বলতে গিয়ে ক্রিকেটের সেই জাতীয়তাবাদী চেতনারই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “১৯৩০ সালে যে দিন জহওরলাল নেহেরুকে গ্রেফতার করা হয়, সে দিনই স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান লর্ডসের মাঠে ইংল্যান্ড তথা উপনিবেশিক শাসকদের বিপক্ষে ২৫৪ রানে অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। ওই সময়ে ব্রাডম্যানও একজন নেটিভ ছিলেন। ”

বার্বাডোজে গেলে একই বুলভার্দে চোখে পড়বে শৃঙ্খলা ভাঙ্গা একজন আফ্রিকান দাস আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট কিংবদন্তি স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স এবং স্যার এভারটন উইকসের ভাস্কর্য। এরপরও যদি উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তারে ক্রিকেটের ভূমিকা বুঝতে না পারেন তবে দেখতে পারেন ফায়ার ইন ব্যবিলন। আফ্রিকান দাসদের উত্তরসূরী একদল ক্রিকেটার অন্য সব দেশকে গুড়িয়ে জানান দিচ্ছে জাতি হিসেবে তাদের দৃঢ় আত্নপরিচয়।

অ্যাশেজ সিরিজ ২০১৭ এর ট্রফি হাতে দুদলের অধিনায়ক

নতুন সহস্রাব্দে এক দশকের কিছু বেশি সময়ে ক্রিকেট দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। এরপর আর কেউই তেমন একটা ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। আর বর্তমান ক্রিকেটে তো একক কোনো পরাশক্তিই নেই। এমনকি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ারও নেই পুরোনো সেই জৌলুস। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটের ওয়েস্ট ইন্ডিজ শাসনের বাতাবরণে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার শতাব্দী প্রাচীন আগুনঝরা দ্বৈরথে ভাটা পড়লেও অ্যাশেজের সময়ে গ্রীষ্মের দিনগুলো ফিরে ফিরে উত্তপ্ত ওঠে জাতীয়তাবাদী চেতনায়।

অবচেতনের গহীনের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ কি লুকানো যায়, বলুন!